|
Date: 2025-06-17 17:02:34 |
মুসলিম উম্মাহর অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এসময় প্রতিটি মুসলমানের ঘরে ঘরে বয়ে যায় ঈদ আনন্দ। মহান আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পশু কোরবানি করা হয়। সেগুলো গরীব-দুখী, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিলিয়ে ও একে অপরের বাড়িতে গিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করা হয়। এই সময়টাতে দীর্ঘ অপেক্ষার পর শিক্ষার্থীরা ছুটি পেয়ে থাকেন। এবারের ছুটি কাটিয়ে আবার ক্যাম্পাসে ফিরছে শিক্ষার্থীরা । কেমন কেটেছে এবার শিক্ষার্থী ঈদ? এবারের ঈদুল আজহার ঈদ আনন্দ তুলে ধরেছেন সোহরাওয়ার্দী কলেজ শিক্ষার্থী মোঃ হাদিসুর রহমান।
ঈদ আনন্দের সাথে জড়িত ছিল সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পরিবেশ সচেতনতা
এবারের ঈদুল আজহা আমার জন্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়ে রইলো। শহরের ব্যস্ততা আর পড়াশোনার চাপ থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম আমার শৈশবের প্রিয় ঠিকানায়—নিজ গ্রামে। ঈদের এই সময়টুকু শুধু আনন্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এর সঙ্গে জড়িত ছিল সামাজিক দায়বদ্ধতা, পরিবেশ সচেতনতা এবং কিছু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বীজ বপনের গল্পও। ঈদের কয়েকদিন আগেই বাড়ি ফিরেছিলাম। বাড়িতে এসেই পরিবারের সঙ্গে মিশে যাই ঈদের প্রস্তুতিতে—কুরবানির গরু কেনা, পরিচর্যা করা, বাড়ির আশপাশ সাজানো, আর ছোট ভাই-বোনদের ঈদের আনন্দে শামিল করানো। ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজ শেষে কুরবানির কাজ, আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আর পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোলাকুলি—সব মিলে দিনটি ছিল এক অপূর্ব আনন্দময় অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে স্কুলজীবনের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া ছিল এবারের ঈদের অন্যতম আনন্দদায়ক অংশ। সবাই মিলে বিকেলবেলা হাঁটা, পুকুরপাড়ে আড্ডা, স্মৃতিচারণ—এইসব মুহূর্তগুলো যেন আবার ফেলে আসা দিনগুলোর ঘ্রাণ এনে দিল। আমি এবার ঈদে পরিবেশ সংরক্ষণের অংশ হিসাবে বাড়ির আঙিনায়, স্থানীয় স্কুলের পাশে এবং রাস্তার ধারে কয়েকটি ফলজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করেছি। আশেপাশের বন্ধুদেরও উদ্বুদ্ধ করেছি একই কাজ করার জন্য। আমাদের সিদ্ধান্ত—প্রতি ঈদে অন্তত ৫টি করে গাছ লাগাবো এবং যত্ন নেবো। এছাড়া এবারে আমি আমাদের উপজেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন—‘পাবলিক ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন’-এ যুক্ত হয়েছি। সংগঠনটির সঙ্গে ঈদের সময় দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারে কুরবানির মাংস বিতরণ করেছি। সেই মুহূর্তগুলো আমাকে বাস্তব জীবনের সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত করেছে এবং বোঝাতে শিখিয়েছে—ঈদের প্রকৃত আনন্দ তখনই পূর্ণ হয়, যখন তা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে, কিন্তু মন রয়ে গেছে গ্রামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈদের ছুটি শেষ। মন যদিও এখনও গ্রামের সহজ-সরল জীবনে রয়ে গেছে, তবুও ফিরে এসেছি শিক্ষাজীবনের ব্যস্ততায়। তবে এবার গ্রামের স্মৃতি শুধু আনন্দের নয়, দায়িত্ববোধের, মানবিকতার এবং ভবিষ্যতের ভাবনার। আমি বিশ্বাস করি, ছোট ছোট উদ্যোগ থেকেই বড় পরিবর্তনের সূচনা হয়। ভবিষ্যতে আমি আমাদের এলাকায় একটি পাঠাগার স্থাপন করতে চাই, যেখানে শিশু-কিশোররা পড়ালেখার পাশাপাশি পরিবেশ ও সমাজ সচেতনতা বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। একইসঙ্গে, গাছ লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষণের একটি নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনাও রয়েছে, যাতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা এবং গ্রামের তরুণরাও যুক্ত হতে পারে।
মোঃ সাইফুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরা সকল উত্তেজনা কে হার মানায়
ঈদুল আজহা মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি, যা কেবল আনন্দ-উৎসবের দিন নয়, বরং ত্যাগ, আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের এক দৃষ্টান্ত।ঈদুল আজহা শিক্ষার্থীদের কাছে শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আত্মত্যাগ ও মানবতা শিক্ষা দেয়।
ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার অনুভূতি যেন সব উত্তেজনাকে হার মানায়। ক্লাস, পরীক্ষা,টিউশনের চাপ থেকে কিছুটা বিরতি নেওয়ার সুযোগ এনে দেয় ঈদুল আজহা।এই ছুটি শুধু কোনো সফর নয়, এটি মানসিক বিশ্রামেরও একটি সুযোগ।মায়ের হাতের খাবার, ভাইবোনদের সঙ্গে সময় কাটানো, কুরবানির পশু দেখাশোনা—এসবই ঈদের আসল আনন্দ।শিক্ষার্থীদের জন্য ঈদ শুধু একটি উৎসব নয়, বরং শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া, পরিবার এর সাথে ভালো সময় কাটানোর এক অপার সুযোগ।
মোছাঃ ইভা আক্তার
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা
ধনী-গরিবে সম্প্রীতি এবং সহানুভূতি সবসময় থাকলে প্রতিদিনই হতো ঈদের দিন
এবারের ঈদুল আযহা ছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর। ২২ মে, বৃহস্পতিবার ছিল জাবিতে ঈদুল আযহার আগে শেষ কর্মদিবস, এরপর থেকেই ছুটি শুরু। মনের মধ্যে একটা উন্মাদনা বয়ে যায়, যদিও ছুটির আমেজটা সাথে সাথে পাইনি কারণ (NILS-LEB) জাতীয় ছায়া সংসদ প্রতিযোগিতায় ২৩ ও ২৪ মে তে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদ কর্তৃক আয়োজিত হয় ও আমি এতে অংশ নিয়েছিলাম। এই উত্তেজনায় ২১ মে’র রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম চলে যাই। সেখানে এক বন্ধুর বাসায় অবস্থান করছিলাম ও ৩ দিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য চোখভরে দেখেছিলাম। পাশাপাশি জীবনে প্রথমবারের মতো ছায়া সংসদ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হলো, অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে পরিচিত হলাম – যেটা অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা ছিল। ২৪ তারিখ রাতের ট্রেনে ঢাকা ব্যাক করলাম। অর্থাৎ আমার ঈদের ছুটির প্রথম তিন দিন কাটলো দারুণ একটা ভ্রমণে। এরপর আস্তে আস্তে শুরু হলো কুরবানির আমেজ, একই সাথে ঈদের আগে বিভিন্ন বিচিত্র রাজনৈতিক সংবাদ উপভোগ করতে লাগলাম! কুরবানির হাটে যাই, যতবার হাটে যাই, ততবার অজানা এক আনন্দে মেতে উঠি। আমি ঢাকাতেই থাকি, আমার স্থায়ী ঠিকানাও ঢাকা। এমনিতেও ঢাকা শহরে ঈদের আমেজ হয়তো অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা কমে যায়, কারণ ঈদের মধ্যে ঢাকায় বসবাসরত অনেকে নাড়ির টানে গ্রামে যান। তবে সেখানে আরেকটি বাড়তি আনন্দ হয় ঈদের দিন ঢাকার রাস্তায় ভ্রমণ। ফাঁকা ঢাকায় মনে হয় এক ঘন্টায় পুরো ঢাকা শহর ঘোরা যাবে, যেটা বছরের অন্যান্য সময় কল্পনাও করা যায় না। এই বিষয়টি আমি দারুণ উপভোগ করি। এছাড়া কোরবানি ঈদে ধনী-গরিবের মধ্যে যে সম্প্রীতি এবং সহানুভূতির মনোভাব সৃষ্টি হয়, তা সারা বছর বজায় রাখতে পারলে বছরের প্রতিটি দিন আনন্দের সঙ্গে কেটে যেত। তাই ঈদুল আজহার এই শিক্ষা আমাদের পুরো বছর ধরে রাখা উচিত। সবশেষে সব কিছুর জন্য শুকরিয়া। এবারের ঈদে একটু বিচিত্র, একটু ভালো, একটু খারাপ – তিনটা অভিজ্ঞতায়ই কমবেশি ছিল। আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুন। আমিন
মো. রাতুল ইসলাম ফারদিন
আইন ও বিচার বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা
ঈদ আর স্বাস্থ্য একটি অদৃশ্য সম্পর্ক
“ ঈদুল আযহা” ছোটবেলায় এ শব্দ মানেই ছিল নতুন জামা, মাংস আর আনন্দ। কিন্তু এখন, একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী হয়ে আমি বুঝতে পারি, ঈদ কেবল নিজের জন্য নয়, বরং অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর, কারও জীবনে কিছুটা স্বস্তি যোগ করার এক উপলক্ষ। এই বছর, ব্যস্ত হাসপাতাল শিফট, ক্লাস ও পরীক্ষার মাঝখান থেকে একটু ছুটি নিয়ে আমি ফিরলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু এবারের ফেরা শুধুই বিশ্রামের জন্য ছিল না—এটা ছিল আত্মপরীক্ষার, আত্মদায়িত্বের এবং নিজের মধ্যে থাকা চিকিৎসকের নীরব শপথ নবায়নের একটি মুহূর্ত। ঈদের ক’দিন আগেই বাড়ি ফিরেছিলাম। familiar faces, known roads, the smell of muddy ponds—সব কিছু যেন বহুদিন পর আবার হৃদয়ে গাঁথা হলো। কুরবানির দিনে যখন সবাই ব্যস্ত ছিল জবাই আর রান্নায়, আমি সময় বের করে আশেপাশের কয়েকজন বয়স্ক মানুষকে ব্লাড প্রেশার মেপে দিলাম, পায়ে ব্যথা থাকা একজন চাচাকে কিছু হালকা ব্যায়াম শেখালাম, আর কয়েকজন কিশোর-কিশোরীকে বুঝালাম—“শুধু খাওয়া নয়, স্বাস্থ্যও গুরুত্বপূর্ণ।” মেডিকেল কলেজে পড়লেও আমি জানি—সব শিক্ষা শুধু বইয়ে থাকে না। এই গ্রাম, এই মানুষরাই আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে কাঁধে শুধু স্টেথোস্কোপ নয়, একটা মানবিক দায়িত্বও বহন করতে হয়। ১৪ জুন থেকে আবার শুরু হয়েছে ক্লাস, রোগী দেখা, ওয়ার্ড রাউন্ড। আমরা সাধারণত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি একটু কম পাই। কিন্তু এবারের গ্রাম ভ্রমণ আমাকে যেন এক নতুন ‘কেস হিস্ট্রি’ দিয়ে দিল—এখানে রোগের না, বরং সম্পর্ক, ভালোবাসা, ও দায়িত্বের। আমি স্বপ্ন দেখি—আমাদের গ্রামে একদিন একটি গ্রামীণ স্বাস্থ্য পাঠাগার গড়ে তুলবো। যেখানে শিশু-কিশোররা শিখবে পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা, মানসিক স্বাস্থ্য আর পরিবেশ নিয়ে। প্রতিমাসে বিনামূল্যে ছোট মেডিকেল ক্যাম্প চালু করবো—যেখানে প্রেসক্রিপশন নয়, ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সুস্থ করা হবে। আমি একজন চিকিৎসক হবো—শুধু রোগ সারাবো না, বরং আশা জাগাবো। আর আমার ঈদের প্রতিজ্ঞা এটাই—এই পথ আমি কখনো ভুলবো না।
মোঃ ফয়সাল ইসলাম রিফাত
শিক্ষার্থী, এমবিবিএস
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর
© Deshchitro 2024