|
Date: 2023-01-07 08:17:07 |
দেশ সেরা স্বেচ্ছাসেবী নারী যোদ্ধা সুফিয়া খাতুন
রনজিৎ বর্মন শ্যামনগর(সাতক্ষীরা)প্রতিনিধি ঃ অর্থ নাই,ক্ষমতা নাই,পদ নাই আছে শুধু মানবিকতা। আর সেই মানবিকতার সাহস নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে যেয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছেন উপকুলীয় এক স্বেচ্ছাসেবী নারী যোদ্ধা।
নিম্ন বিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষের পাশে থেকে আজ সে সমাজে রাজনৈতিক যোদ্ধা নয় এক জন মানবিক যোদ্ধা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। এই যোদ্ধা হল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ইউপির শংকরকাটি গ্রামের শহর আলীর কন্যা সুফিয়া খাতুন(৩৩)।
তিনি সম্প্রতি ভিএসও ইন বাংলাদেশের আয়োজনে ঢাকার ধানমন্ডিতে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে ভিএসও ইন বাংলাদেশের কান্ট্রি পরিচালকের নিকট থেকে ভিএসও এর বাংলাদেশের সকল স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে দেশ সেরা স্বেচ্ছাসেবকের সম্মাননা স্বারক গ্রহণ করেন। সম্মাননা স্বারক হিসাবে ক্রেষ্ট, সনদপত্র,নগদ অর্থ ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়। এ সময় বাংলাদেশ সহ ভিএসও এর কর্মএলাকার ২৪টি দেশের স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ ভাচুয়ালী যুক্ত হয়ে সমগ্র অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন এবং দেশ সেরা নির্বাচিত স্বেচ্ছাসেবক সুফিয়াকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানে সম্মাননা স্বারক গ্রহণ কালিন উপস্থিত ছিলেন যার হাত ধরে সুফিয়া স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন নকশীকাঁথার পরিচালক চন্দ্রিকা ব্যানার্জী। সুফিয়া অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেন নকশীকাঁথা সংগঠন ও তার পরিচালক চন্দ্রিকা ব্যানার্জী যিনি মায়ের মত আগলে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তার কারণে আজ এই সফলতা। উল্লেখ্য যে ভিএসও ইন বাংলাদেশের প্রকল্পভুক্ত একটি সংগঠন নকশীকাঁথা।
দেশ সেরা স্বেচ্ছাসেবক সুফিয়া এক সাক্ষাতকারে জানায় তার পিতার আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকার জন্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরই তার বাল্য বিয়ের স্বীকার হতে হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে স্বামী ইটের ভাটায় কাজ করতে যেয়ে মারা যান এবং সন্তান জন্মের পরই মারা যাওয়ায় বর্তমানে তিনি একাকি জীবন যাপন করছেন।
সুফিয়ার তিন ভাই জন্মের পর কেন কন্যা সন্তান সুফিয়ার জন্ম হল এ কারণে পিতা শহর আলী আবার দ্বিতীয় বিবাহ করে পৃথকভাবে দূরে বসবাস করেন। বর্তমানে তিন ভাই তিন জায়গায়তে বাস করলেও কারো সাথে কারো যোগাযোগ এক প্রকার নেই। এ অবস্থায় মাতাকে নিয়ে সুফিয়া কঠিন পরিশ্রম করে দিন যাপন করতে করতে গত কয়েক মাস আগে মারা যান তার মা। ভিটে মাটি কিছু নাই নিরুপায় হয়ে পিতার নিকট থেকে ২ কাঠা জায়গা শেষ পর্যন্ত ক্রয় করে বসবাস করছেন।
সুফিয়া নিজের দুঃখ কষ্ট ভূলে থাকতে এবং পরিবারের ব্যয় ভার চালাতে সাথে সাথে তার মত যেন নারীদের এমন কষ্ট সহ্য করতে না হয় তাই মনোনিবেশ করেন সামাজিক কাজ কর্মে। পরিচয় হয় শ্যামনগর নকশীকাঁথা মহিলা সংগঠনের পরিচালক চন্দ্রিকা ব্যানার্জীর সাথে। তার সহায়তায় দর্জি প্রশিক্ষণ , সেলাই কাজ, কৃষি বিষয়ে ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরী প্রশিক্ষণ সহ অন্যান্য কার্যক্রমে যুক্ত হতে থাকেন।
সুফিয়া খাতুন নকশীকাঁথার সহায়তায় শংকরকাটি প্রচেষ্টা মহিলা উন্নয়ন সংগঠন নামে ৬০ জন মহিলাদের নিয়ে একটি নারী সংগঠন তৈরী করেছেন। যার সভানেত্রী তিনি নিজে। ধর্মান্ধতার কারণে নারীদের নিয়ে সংগঠনটি করতে যেয়ে তাকে কয়েকবার হুমকির সম্মুখিন হতে হয়, সংগঠনের সাইনবোর্ড উঠিয়ে ফেলে দেওয়া ,বিভিন্ন মন্তব্য করা ইত্যাদি। তার পরও পিছুপা না হয়ে ভাল উদ্দেশ্য থাকার কারণে এখন গ্রামবাসী সহায়তা করে থাকেন। গ্রামবাসী সুফিয়ার সফলতার জন্য বর্তমানে গর্ববোধ করেন।
সুফিয়া খাতুন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকায় বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, দূর্যোগকালিন সময়ে বৃদ্ধদের সাইকোন শেল্টারে নিয়ে যাওয়া, করোনাকালিন সময়ে নারীদের সচেতনতায় কাজ করা, ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরী করে নিজে সহ কয়েকজন নারীকে স্বাবলম্বী করা, নারী নির্যাতনে ভূমিকা রাখা, এলাকায় হাঁস মুরগীর ভ্যাকসিন প্রদান করা, নারী উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সহ অন্যান্য সামাজিক কাজ করায় এলাকার মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন। এখন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, বিভিন্ন এনজিও এলাকায় কোন কাজ করতে গেলে সুফিয়া খাতুনের খোঁজ খবর নেন।
বর্তমানে একজন নারী স্বেচ্ছা সেবক হিসাবে পরিচিতি লাভ করায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাকে বিভিন্ন পদে নিযুক্ত করেছেন। তিনি কাশিমাড়ী ইউনিয়ন সিপিপির একজন অন্যতম নারী সদস্য, ব্রাকের যক্ষ্মা রোগী বাছাই কমিটির সদস্য, শ্যামনগর জলবায়ু পরিষদের স্বেচ্ছাসেবক, নকশীকাঁথার স্বেচ্ছাসেবক, ওয়াল্ডভিশন এনজিওর গর্ভবতী নারী বাছাই কমিটির সদস্য,আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য, সুশীলন এনজিওর বয়স্ক শিক্ষা কমিটির সদস্য, শংকরকাটি কমিউনিটি কিনিকের কার্যকরী কমিটির সদস্য, কাশিমাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, ইউনিয়ন পুলিশিং কমিটির সদস্য, ইউনিয়ন আনসার ভিডিপির সদস্য,নবযাত্রা প্রকল্পের গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সদস্য, উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিসের নারী ভ্যাকসিনেটর, শংকরকাটি প্রচেষ্ট মহিলা উন্নয়ন সংগঠনের সভানেত্রী,দেওল সরকারি প্রাইমারী স্কুলের কমিটির সদস্য, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের কর্মসৃজন প্রকল্পের সুপারভাইজার পদ সহ অন্যান্য সংগঠনের সাথে স্বেচ্ছা শ্রমে কাজ করছেন এবং করেছেন। বিভিন্ন সময়ে জেলা, উপজেলা ও দেশের অন্যান্য স্থানে যেয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
তিনি বলেন তার এলাকায় ৮টি বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছেন প্রশাসনের সহায়তায়। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকায় প্রায় ১২টি বাল্য বিবাহ বন্ধের জোর তৎপরতা চালিয়েছেন। কয়েকজন নারীকে নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে উপজেলা ওসিসি কর্মকর্তা ও থানায় নিয়ে সহায়তা করেছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান সুফিয়া খাতুনকে চেনেন এবং জানেন তাদের মাধ্যমে নারীদের সহায়তা করার চেষ্টা করেন।
সুফিয়া খাতুন কোন কাজকে ছোট না ভেবে নিজে সব কিছু করার চেষ্টা করেন সে কারণে দূর্যোগ কালিন সময়ে সংকেত পতাকা উঠানো ও নামানো, সাইকোন শেল্টার পরিস্কার করা ও বৃদ্ধা এবং প্রতিবন্ধীদের সাইকোন শেল্টারে নিয়ে যাওয়া, নিজের আয়ের উৎস বৃদ্ধিতে এলাকায় নারীদের বাড়ী বাড়ী যেয়ে মনোহারী মালামাল বিক্রয় করা, গ্রাম থেকে বিষ মুক্ত সবজি ক্রয় করে ভ্যানে বহন করে উপজেলা সদরের নকিপুর বাজারে বিক্রয় করা, কেঁচো কম্পোষ্ট তৈরী ও বিক্রী করা , হাঁস মুরগীর ভ্যাকসিন প্রদান করা, সুপেয় পানির অভাব নিরসনে পানির জার বাড়ী বাড়ী পৌঁছে দেওয়া ও অন্যান্য কাজ করে থাকেন। এ সকল কাজ করে যা আয় হয় সেটা দিয়ে নিজের ও নিজের পরিবারের ব্যয়ভার বহন করে থাকেন। এখন তার তৈরী কম্পোষ্ট সার উপজেলা কৃষি অফিস, এনজিও প্রতিষ্টান, উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিস, গ্রামবাসী ক্রয় করে থাকেন। এ সকল কাজের সাথে তার নারী সংগঠনের নারীদেরকে যুক্ত করেন।
সুফিযার এই মনোবল ও মানষিকতার জোর দেখে বিভিন্ন সময়ে অনেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্ত সব প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন এবং সমাজের মানুষের জন্য কিছু করতে চান বা বাঁকী জীবনটা এভাবে কাটাতে চান বলে তাদেরকে অবহিত করেছেন। মাঝে মাঝে তার এ সকল কাজ করতে যেয়ে জীবনে হুমকীও এসেছে বলে জানান কিন্ত সে গুলি ধৈর্য্য ও সাহসের সাথে মোকাবেলা করেছেন।
সুফিয়ার এই সকল কাজের সফলতার স্বীকৃতি স্বরুপ গত ২০২০ সালে উপজেলা প্রশাসনের থেকে জয়িতা পুরস্কার লাভ করেছেন।এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারী সংগঠন থেকে ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উদ্যমী নারী স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে সম্মাননা লাভ করেছেন। সর্বশেষ ২০২২ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ যুব সংগঠন হিসাবে জেলা প্রশাসকের নিকট থেকে অনুদানের চেক গ্রহণ করেন।
সুফিয়া অতি সাধারণ নিম্মবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও শুধু সদ ইচ্ছা ও মনোবল শক্তি নিয়ে সকল দুঃখ কষ্টকে জয় করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার এ সফলতা আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে সাথে সাথে নারীদের মধ্যে একজন সফল স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে দেশের মধ্যে উদাহরণ সৃষ্টি করবেন এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যশা।
ছবি- ঢাকার ধানমন্ডিতে এক অনুষ্ঠানে ভিএসও বাংলাদেশের কান্ট্রি পরিচালকের নিকট থেকে দেশ সেরা স্বেচ্ছাসেবক সম্মাননা গ্রহণ করছেন সুফিয়া খাতুন।
© Deshchitro 2024