◾অমিত হাসান 


সময় কত চমৎকারই না দেখায় মানুষেরে! সময়ের অবিরত ছুটে চলার সাথেই আমাদের এ জীবন, আমাদের বেঁচে থাকা । এ জীবন পরিক্রমার মধ্যে জীবনে আসে কত ঝড়, কত দুঃখ, হাসি-বেদনা । সময়ই আমাদের বুঝিয়ে দেয় জীবনে হাসির পেছনেও যে লুকিয়ে থাকে কত বিষাদমাখা গল্প আর মধুর বিপরীতে বিষ । তবুও এ জীবন যে থেমে থাকবার নয় । সে নদীর স্রোতের মতোই সদা প্রবহমান । 


আমাদের গ্রাম থেকে একটু দূরেই ঢাকা-ভৈরব রেলপথ । ছোট থেকে কতবার যে এ পথে ট্রেন চলতে দেখেছি তাঁর ইয়ত্তা নেই । কিন্তু ট্রেনকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগটা কোনোভাবেই আসছিলো না । পাড়ার বন্ধুরা বলতো তাঁরা নাকি ট্রেনে চড়েছে । ওদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আমাকেও ট্রেনের প্রতি আকৃষ্ট করেই চলছিলো । কিন্তু আমার জীবনে ট্রেনগুলো কত কাছে থেকেও যেন কতদূর? মায়ের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে বলতাম,"মা,আমি কি কোনোদিন ট্রেনে ওঠমু না ? আমি তো বাসে বমি করি, ট্রেনে করমু না দেইখো । একদিন ট্রেনে কোথাও একটা নিয়ে যেও । " 

মাকে কখনো কখনো রাজি করাতে পারলেও বাবা হেসে উড়িয়ে দিতেন । বলতেন তুমি আগে বড় হও বাবা । আমার প্রাক শৈশবে নাকি আমি একবার পরিবারের সঙ্গে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে বাসায় এসেছিলাম । সেদিন নাকি আমি এত বেশি কান্না করেছি যে তারপর আর কখনোই কেউ আমায় নিয়ে ট্রেনে ওঠার সাহস করে নি । 


ছবি: লেখক অমিত হাসান


এদিকে শামসুর রাহমানের লেখা ট্রেন কবিতার লাইনগুলো আমাকে আরো উতলা করে রেখেছিলো ট্রেনে ওঠার জন্য । কবিতার একটা পঙক্তি আমার খুব পছন্দের ছিল ----

"পুলের ওপর বাজনা বাজে /ঝন ঝনাঝন ঝন " ।

আর এদিকে বাড়ির অদূরে ঘোড়াশাল ব্রিজে এসে ট্রেনে যখন বাঁশিটা বাজতো সে সুর আমায় ঘরে রাখতে পারতো না । চলে আসতাম বাড়ির দক্ষিণ দিকটায়, যেখান থেকে মাঠের ওপারে রেললাইন দিয়ে ট্রেন চলতে দেখা যায় । কবির ভাষায় -"একটু জিরোয় ফের ছুটে যায় /মাঠ পেরোলেই বন" । 


কবিতার শেষদিকটায় যখন কবি বলেন থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি একটু কেশে খক/আমায় নিয়ে ছুটবে আবার ঝক ঝকাঝক ঝক তখন যেন আমার বাঁধ আর কোনোভাবেই শইতো না । ইচ্ছে হতো ট্রেনগুলোতে ওঠে পরি । কিন্তু এ মজার গাড়িগুলো তো আমায় আর নিলো না । 


অবশেষে, বুঝ হওয়ার পর ২০১৬ সালে আমি যখন ক্লাস টেইনে পড়ি তখন সুযোগ আসে ট্রেনে ওঠার । আমাদের উপজেলা থেকে লোকাল ট্রেনে ঢাকা যাওয়া মোটামুটি ১ ঘণ্টার পথ । স্টেশন থেকে টিকেট করার পর যখন জানতে পারলাম লোকাল ট্রেনগুলোয় বসার সিটসমেত টিকেট ইস্যু করা হয় না তখন বহু বছর আগে বাবার বলা কথাটার মর্মার্থ আমি বুঝতে শুরু করেছি । কেন তিনি আমাকে নিয়ে আমাদের বাড়ির কাছ দিয়েই যাওয়া লোকাল ট্রেনে ওঠতে চাইতেন না । 

ছবি: লেখক অমিত হাসান ও তার সহপাঠীরা


আমার এরপরের জীবনটায় ট্রেনের সাথে কিংবা আরেকটু খোলাসা করে বললে লোকাল ট্রেনগুলোর সাথে যে সখ্যতা গড়ে ওঠেছে তা যে কোনোভাবেই ভুলবার নয় । ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় থেকেই মূলত ট্রেনের সাথে আমার সম্পর্ক দৃঢ় হতে শুরু করে । তারপর থেকে ট্রেনগুলো আমায় কেন যেন আর রেখে যেতে চায় না । আমি কখনো ট্রেনের জন্য ৫ মিনিট লেট করলে দেখা যায় ট্রেন করেছে ১০ মিনিট লেট ! আবার কখনো দেখি আমি স্টেশনে পৌঁছা মাত্রই ট্রেন এলো । অবশ্য ট্রেনের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা বা শিডিউল বিপর্যয়ের শিকার যে আমি হই নি তা বলা যাবে না । তবে আমি কি আর আমার প্রিয়তমের দোষ বলতে পারি ? 


এসএসসির পর একটা সময় আমার স্কুলের বন্ধুরা সকালে একসাথে ঢাকায় এসে ক্লাস করতাম, আবার দুপুর বা বিকেলের ট্রেনে বাসায় ফিরতাম । কিন্তু এইচএসসি ফলাফলের পর বন্ধুরা একেকজন একেক দিকের বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মস্থলে চলে গেলো । পরে রইলাম শুধু আমি । ট্রেনকে যে কোনোভাবেই ছাড়তে পারি নি । প্রাকশৈশবে যে ট্রেন ছিল আমার কান্নার কারণ, শৈশবে তা স্বপ্ন আর কৈশোর থেকেই বাস্তব । সদ্য কৈশোরে এসে নতুন করে যে পরিচয়টা হয়েছিল ট্রেনগুলোর সাথে এখন সে পরিচয়টা রুপ নিয়েছে এক আবেগে,এক ভালোবাসায় । আর তাঁর গভীরতা বেড়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রবীন্দ্রনাথের মতো করে বলতেই হয়, "যতবার যেতে চাহি,ততবারই কহে/আমি ভালোবাসি যাঁরে/সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে?" 


এরমধ্যে গত কয়েক বছরে ট্রেন ভ্রমণ করতে গিয়ে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা যে হয়েছে আমার । চলার পথে নতুন কতশত সহযাত্রী যে পেয়েছি, পেয়ছি কত বন্ধু আর কত অপরিচিতির সাথে হয়েছে পরিচয় । 

অবশ্য হারানোর তালিকাটাও বেশ দীর্ঘ । স্টেশনে বসে অথবা ট্রেনের কোনো কামড়ায় চির অপরিচিত মানুষগুলো কত আপন করে নিতো আমায় । কেউকেউ ফোন নাম্বার বা ফেসবুক আইডি রেখে দিতো । এরপর কেউ যোগাযোগ রেখেছে, কেউ রাখে নি । তবে কিছু মানুষ আছে যাদের কথা না বললেই নয় । তারা যে আমার নিয়মিত সহযাত্রী,আমার ভাই । বছরের পর বছর ধরে মানুষগুলো ঢাকার প্বার্শবতী নরসিংদী এবং গাজীপুর জেলার বিভিন্ন স্টেশন থেকে এসে গিয়ে ঢাকায় অফিস করে । 


কিন্তু এ পথচলা মোটেই সহজ নয় । লোকাল বাসের মতো লোকাল ট্রেনগুলোতেও বেশিরভাগ সময়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । সেই সাতসকালে বাসা থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার সময় লোকে লোকারন্য ট্রেনে ফিরতে হয় বাড়ি । 


প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2023