ছবি- দরবারে প্রবেশের মেইন গেইট।
যুগে যুগে পৃথিবীর ত্রাণকর্তা হিসেবে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জন্মেছেন, তাদের মধ্যে হজরতুল্লামা শাহ্ আবদুল মালেক আল-কুতুবী (রহ.)মানুষের অন্তরে ঈমানের চেরাগ জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য তাসাউফ চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ১৯৬০ সালে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া থানার দ: ধুরুং গ্রামে কুতুব শরীফ দরবার প্রতিষ্ঠা করেন। বহুমাত্রিক জ্ঞান ও প্রতিভাগুণে মালেক শাহ হুজুরের যশ-খ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়েছে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে তাঁর রয়েছে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা। আত্মিক শুদ্ধ পুরুষ হিসেবেও তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম। দেশবরেণ্য এ মহান মনীষীর প্রকৃত নাম শাহ্ আব্দুল মালেক। প্রসিদ্ধ নাম হচ্ছে- কুতুবদিয়ার মালেক শাহ্ বা শাহ্ সাহেব হুজুর। তিনি ১৯১১ সালের ১১ জুলাই মাসে কক্সবাজার জেলার পূর্ণভূমি কুতুবদিয়া দ্বীপের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর মহীয়সী মায়ের নাম মরহুমা বদিউজ্জামাল এবং তাঁর বাবার নাম হাফেজ শামসুদ্দীন রহ.। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুব গাম্ভীর্য ও পরহেজগার প্রকৃতির। সাত বছর বয়স থেকেই তাহাজ্জুদ গুজার ছিলেন। গ্রামেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। চট্টগ্রামের দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম ও ফাজিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। উচ্চ শিক্ষার্থে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। জ্ঞানের জগতে তাঁর বিচরণ ছিল অসাধারণ। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা এতোই সূক্ষ্ম ও প্রখর ছিল যে, কিতাবের বা বইয়ের কোন পৃষ্ঠায় কী লেখা আছে, তা হুবহু মুখস্থ বলে দিতে পারতেন! অর্জিত জ্ঞানের পাশাপাশি ইলমে লাদুন্নীতে ভরপুর ছিলো তাঁর প্রশস্ত অন্তর। এ জ্ঞান অত্যন্ত দুর্লভ ও অদৃষ্টপূর্ব। তার ভাষাগত দক্ষতা ছিল ছন্দময় ও সাবলীল। শব্দচয়ন, শব্দগঠন, শব্দশৈলী, বাচনভঙ্গি, মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল ও বুঝানোর দক্ষতা ছিল অনন্য। জ্ঞানের এমন কোনো শাখা-প্রশাখা নেই, যেখানে তাঁর অবাধ বিচরণ ও দক্ষতা ছিল না। ইলমে তফসির, ইলমে হাদিস, ইলমে ফিকাহ্, ইলমে উসুল, ইলমে নাহু, ইলমে সরফ, ইলমে বালাগাত, ইলমে ফাসাহাত, ইলমে মানতেক, ইলমে ফারায়েজ, ইলমে শরিয়ত, ইলমে তরিকত, ইলমে হাকিকত, ইলমে মারেফাত ও ইলমে তাসাউফ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়।
আলেম সমাজের কাছে তিনি বাহরুল উলুম নামে সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন ইমামুল উলুম ওয়াল ফুনুন। দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালে তাঁর দাদাপীর শায়খুত তরীক্বত, হযরত শাহ্সূফী আলহাজ্ব মাওলানা হাফেজ হামেদ হাছান আলভী আজমগড়ী রহ. এর নির্দেশক্রমে কাদেরীয়া সিলসিলার পীর হযরত হাফেজ ছৈয়দ মুনির উদ্দীন নুরুল্লাহ রহ. এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে খেলাফত প্রাপ্ত হন। খেলাফত প্রাপ্তির পর কয়েকজনকে তরীক্বতের সবক দিয়েছেন কিন্তু পরক্ষণেই তাঁদের পুনরায় সবক দেওয়া হতে বিরত থাকেন। তাঁর পরম ইচ্ছা ছিল আল্লাহর প্রেম সাগরে ডুব দিয়ে সরাবে ইলাহী পান করা। এজন্য তিনি পীরতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে একাকীত্বকে বেঁচে নিয়েছিলেন রেয়াজতের জন্য।
তিনি ১৯৪৯ সালে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল দ. এর সান্নিধ্য লাভের চরম ও চূড়ান্ত দুরূহ পথ অতিক্রমে নিমগ্ন হন। অর্ধাহারে এমনকি অনাহারে বনে-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে, নদী-সমুদ্রে একাকী নির্জনে গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে সাধনা বা রেয়াজতের কঠিন পর্যায় অতিবাহিত করেন। অতঃপর ফানা-ফিশ শায়খ, ফানা-ফির রাসুল দ., ফানা-ফিল্লাহ ও বাকা-বিল্লাহ স্তরগুলো অতিক্রম করে বেলায়াতের সর্বোচ্চ স্তরে পদার্পণ করেন। তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকতেন প্রায় সময়। এ জন্য সূফিবাদী কবি নজরুল বলেছেন, ‘খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে।’
তিনি ভক্তবৃন্দদের নিয়ে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকতেন প্রায় সময়। জিকির চলাকালীন সময়ে তাঁর ঈমানি শক্তি কয়েকশ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে আল্লাহর প্রেমে বিভোর হয়ে পড়তেন। নূরের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে জ্যোতির্ময় হতো তাঁর পুরো শরীর। চেহারাতে নূরের রশ্মি ছিল প্রখর। তাই মওলানা রুমী রহ. বলেছিলেন, ‘আল্লাহর ওলীর সাথে এক মুহূর্র্ত সান্নিধ্য লাভ করা শত বৎসরের এবাদতের চাইতে উত্তম।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যারা ওলী আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকবে তারা খোদার রহমত লাভের পথ থেকে দূরে সরে পড়বে।’ আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের দোয়া আল্লাহর দরবারে অফেরৎযোগ্য। এজন্য মওলানা রুমীর প্রসিদ্ধ উক্তি হচ্ছে, ‘ওলিগণ আল্লাহর নিকট হতে এমন ক্ষমতা লাভ করেন যে তাঁরা নিক্ষিপ্ত তীরকে মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন।’
এদিকে ১৯৬০ সালে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায় কুতুব শরীফ দরবার প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী সময়ে চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা কুরবান আলী সওদাগরের বিল্ডিংয়ে ও মাঝিরঘাট শফিক আহমদ সওদাগরের বাড়িতে আধ্যাত্মিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করতেন। পাঞ্জেগানা নামাজে নিজেই ইমামতি করতেন প্রায় সময়। নামাজ শেষে হাজেরানে মসলিশ নিয়ে দ্বীনি বয়ান, ওয়াজ-নসিহত, জিকির-আজকার ও মুরাকাবা-মোশাহাদা পরিচালনা করতেন। তাঁর সান্নিধ্যে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে নামাজের পরে আল্লাহ আল্লাহ শব্দ দিয়ে উচ্চস্বরে জিকির করতেন। জিকির ছিল তাঁর রূহের খোরাক। এ জিকিরে রুগ্ন কলব সতেজ হতো! এ জিকিরে আল্লাহর সন্ধান মিলত। এ জিকিরে মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হতেন।
ইসলাম ধর্মের সুমহান বাণী প্রচারে বহুবার বাতিলপন্থীদের আক্রমণ ও জুলুমের শিকার হয়েছিলেন তিনি। বাতিলপন্থীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্যে সত্যকে স্বগৌরবে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। তাঁর আধ্যাত্মিক কর্মযজ্ঞকে ভণ্ডামী তকমা লাগানো বহু জ্ঞানী গুণী আলেম তাঁর কাছে লজ্জিত ও পরাভূত হয়েছেন বহুবার। তিনি মিথ্যাকে সত্য দিয়ে আঘাত করতেন। নামধারী ধর্ম ব্যবসায়ীর রাজনৈতিক নেতা-কর্মীগণ তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্য চেষ্টা করেছেন; এমনকী বন্দুক পর্যন্ত তাক করেছিলেন!
১৯৭৬ সাল থেকে ৮৫ সাল অবধি তিনি সিরাতুন্নবী দ. মাহফিল চালু করেছিলেন। উক্ত মাহফিল দেশবরেণ্য আলেমদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। তাঁর জীবনযাপন, চলাফেরা ও আচার ব্যবহার ছিল সুন্নাতময়।
তিনি ছিলেন খুবই সূক্ষ্মদর্শী এবং তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল সুগভীর। প্রতিটি কথা কোরআন ও হাদিসের তথ্যময় জ্ঞানভাণ্ডারে সমৃদ্ধশালী ছিল। অনর্থক, অহেতুক ও বেফাঁস কোনো কথা বলতেন না। তিনি বলতেন, ‘আমি আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোনো কিছুই করি না। আমাকে আল্লাহ তা’লা শেষ জামানার গুণাগার উম্মতে মুহাম্মাদির পাহারাদার বা জিম্মাদার হিসেবে নবুয়তের খাদেম ও বেলায়েতের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন।’ তিনি আরও বলতেন, ‘আমি নবী করিম দ.’র গাট্টি বহনকারী। একটি মুহূর্তও আমার ফুরসত নেই। আমি সর্বক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল দ.’র অর্পিত দায়িত্ব পালনে সদাব্যস্ত।’
তাঁর জীবন ছিল অসংখ্য কারামতে সমৃদ্ধ। এমন কোনো মুহূর্ত ছিল না তাঁর থেকে কারামাত সাবিত বা প্রকাশিত হয়নি।
হজরতুল্লামা শাহ্ আবদুল মালেক মুহিউদ্দীন আজমী রহ. ছিলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর মাঝিরঘাটস্থ মরহুম আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম সেরু মিয়ার বাসভবনে অসংখ্য অগণিত ভক্ত অনুরক্তদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর অনুস্মরণ ও অনুকরণ বাস্তব জীবনে সফলতা বয়ে আনবে। মানুষ কর্মে ও সৃজনে বেঁচে থাকে চিরকাল। তাঁর আধ্যাত্মিক অলৌকিক কর্মযজ্ঞে বেঁচে আছেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে।
এছাড়া,দরবারে প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত ভক্ত-অনুরক্ত ও আশেকানদের থাকা-খাওয়া, ইবাদাত বন্দেগীর ব্যবস্হা রয়েছে।এবং প্রতি আরবি মাসের চাদের ১২তারিখ মাসিক ফাতেহা ও ইংরেজীে মাসের ১৯ ফেব্রুয়ারি বার্ষিক ফাতেহা অনুষ্ঠিত হয়।প্রতি বছরের বার্ষিক ফাতেহায় জাতি,ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লাখো লাখো ভক্ত,অনুরক্ত অনুষ্টানে অংশ গ্রহন করে।
৭ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
৭ ঘন্টা ৫৪ মিনিট আগে
৮ ঘন্টা ৩ মিনিট আগে
৮ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে
৮ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
৮ ঘন্টা ৫৬ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ৩৪ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ৩৭ মিনিট আগে