◾ ড. মোহিত উল আলম
১৯৭১ থেকে ২০২২। স্বাধীনতা অর্জন-উত্তর দীর্ঘ এই ৫১ বছরে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রত্যয়-স্বপ্ন বাস্তবায়ন কিংবা পূরণে আমরা কতটা সক্ষম হয়েছি-এই প্রশ্নটি ফিরে ফিরে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব-নির্দেশনায় সমগ্র জাতি একটি লক্ষ্য নিয়ে যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা হলো-স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনা।
বঙ্গবন্ধুর অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই চার নেতাসহ আরও অনেক রাজনৈতিক নেতার ইস্পাতকঠিন ঐক্য মুক্তিকামী মানুষকে আরও শক্তি জুগিয়েছিল। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করি জাতীয় চার নেতাকে। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা আত্মদান করেছেন এবং যে মা-বোনেরা লাঞ্ছিত হয়েছেন, তাঁরাসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিগত ৫১ বছরে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছি-এই সত্য অস্বীকারের কোনো পথ নেই। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন, শিক্ষা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতির দাগটা কম মোটা নয়। স্বাধীনতার আগেতো বটেই, স্বাধীনতা অর্জনের পরও আমাদের রাজনৈতিক অর্জন কম নয়। একইসঙ্গে এও সত্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্জনের বিসর্জন ঘটেছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা কিংবা কারও কারোর হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের অপচেষ্টার কারণে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়োত্তর বাংলাদেশে খুব স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে যে সংবিধানটি আমরা পেয়েছিলাম, তাতেও পচাত্তর পরবর্তী শাসকরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বারবার আঘাত করে। এবারের বিজয় দিবসে বড় প্রত্যাশা-আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে ফেরত চাই বাহাত্তরের সেই সংবিধান।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আজও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা যতই বলি গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে, কিন্তু এই সত্য অস্বীকারের পথ নেই, গণতন্ত্রকে এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়নি। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এখনও উগ্রবাদী-ধর্মান্ধরা ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায়। অথচ এই অন্ধকার জাতি দূর করেছিল একাত্তরে। সাম্প্রদায়িকতার উৎস নির্মূল করতে না পারার ব্যর্থতা প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আপস করেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বলে দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলোও। এই স্ববিরোধিতা জিইয়ে রেখে আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে পারব কি? দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সব থেকে জরুরি প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক শক্তির জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। একইসঙ্গে জোর দিতে হবে বৈষম্য নিরসনে। আগেই বলেছি, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছে ব্যাপক, কিন্তু এর সুফল সবাই সমভাবে পাননি। নির্বাচনী ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া আমি মনে করি, সংবিধানের আলোকে হওয়াই উচিত। তবে এক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার যেসব অভিযোগ আছে, তা উড়িয়ে না দিয়ে গণতন্ত্র, সুস্থধারার রাজনীতি এবং সর্বোপরি দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে সুরাহা করা উচিত।
আমি স্পষ্টতই মনে করি, একাত্তরে যারা আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে, হত্যাযজ্ঞে নানাভাবে সহায়তা করেছে এবং আমাদের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল, তাদের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা উচিত। গণতন্ত্রের যে অনুষঙ্গগুলো রয়েছে, এর যেন কোনো ক্ষেত্রেই কোনোরকম ব্যত্যয় না ঘটে-এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রাজনীতির নীতিনির্ধারক ও দেশপ্রেমিক সবার আত্মজিজ্ঞাসা হোক আমরা মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কতটা সফল হয়েছি, কতটা অসফল হয়েছি। অসফলতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেই দিকটায় বিশেষ করে নজর দেওয়া উচিত। এদেশের সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের জন্য অনেক মূল্য দিয়েছে-এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। মেধার বিকাশ, সৃষ্টির উৎকর্ষ তুলে ধরার মধ্য দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে। নাগরিক সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সব স্তরের মানুষের অধিকারের মাঠ সমতল করা জরুরি। এগুলো এখনও আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জন করতে পারিনি। তরুণ সমাজের মধ্যে জরাজীর্ণ সমাজকে নতুন করে গড়ার যে প্রত্যয় দেখা যাচ্ছে, তা কাজে লাগাতে হবে। এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। সবার মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার দায় সরকারের। যদি বৈষম্যের ছায়া সরানো না যায়, তাহলে উন্নয়ন টেকসই করা যাবে না। ন্যায্য সমাজ গঠনে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক এবং সুশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজন অনেক ক্ষেত্রেই কাঠামোগত পরিবর্তন।
স্বার্থান্বেষী মহলের সব চক্রান্তের পথ রুদ্ধ করতে নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। দেশবিরোধী, মানুষের কল্যাণবিরোধী চিন্তা যারাই করবে তাদের বিরুদ্ধে নির্মোহ অবস্থান নিতে হবে সরকারকে। পঞ্চাশ বছর একটি জাতির জন্য কম সময় নয়। আমরা বিজয় অর্জনের পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ইতোমধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছি। আমাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও একইসঙ্গে দারিদ্র্য হ্রাস পেলেও আয়বৈষম্য এবং সামাজিক বিভেদ বেড়েছে। এর মানে আমাদের উন্নয়নের, অর্জনের ন্যায্য বণ্টন হয়নি এবং বিভিন্ন সামাজিক শক্তি, যারা আমাদের উন্নয়নকে চালিত করেছে, তারা যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি। আজকের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়গুলোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন মনে করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক, গবেষক
১ দিন ৮ ঘন্টা ৫১ মিনিট আগে
২ দিন ৮ ঘন্টা ৫১ মিনিট আগে
৬ দিন ১৮ ঘন্টা ২৬ মিনিট আগে
৯ দিন ২ ঘন্টা ২৮ মিনিট আগে
১৫ দিন ১৪ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে
১৬ দিন ৭ ঘন্টা ২২ মিনিট আগে
১৭ দিন ৪ ঘন্টা ৫৪ মিনিট আগে
১৮ দিন ৬ ঘন্টা ৭ মিনিট আগে