◾ বিশাল সাহা
স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এই মহাকাব্যিক শব্দগুলো জন্ম লগ্ন থেকে শুনে আসছি, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশের আলো বাতাস উপভোগ করছি। মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক গল্প, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস বইপত্র, প্রামাণ্যচিত্র থেকে জানতে পারছি, জানতে পারছি মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিঃস্বার্থ অবদান। ফুটবল খেলে অর্জিত অর্থ কিংবা ভিনদেশী জর্জ হেরিসনের মিউজিক্যাল কনসার্টে উপার্জিত অর্থ মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে দেওয়া অনন্য নজির। পাশাপাশি সিনেমা, গান, আঁকা ছবি, কবিতার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেওয়া একই সাথে নান্দনিক ও তৎকালীন সময়োপযোগী। অনুপ্রেরণার কথা বলতে গেলে কবিতার কথা একটু জোর দিয়েই বলতে হয়।
মনের আবেগ, অনুভূতি, রাগ, ক্ষোভের দূর্দান্ত মিশেল কবিতা। সময়ের কানে সব সময়ই সঠিক স্পন্দন দিয়েছে কবিতা। যে কোনো আন্দোলনেই কবির কবিতা হয়ে উঠেছিলো প্রতিবাদী অস্ত্র। ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবচেয়ে বেশি স্পন্দিত করেছে কবিতা শিল্পকে।
বাঙালির আনন্দ-অধিকারের কাল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। বাংলা কবিতায় ১৯৭১ সালের তাপ ও মমতা ছড়িয়ে আছে প্রগাঢ় ভাবে। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে কবিরা সময় ও সংগ্রামকে এঁকেছেন পরম শ্রদ্ধায় ও স্নেহে। মুক্তিযুদ্ধকালীন কবিরা অতন্দ্রপ্রহরীর মত কবিতা লিখে মুক্তিবাহিনীকে উজ্জিবীত করে ভূমিকা রেখেছে। দেশভাগ তথা ১৯৪৮ পরবর্তী সময় থেকেই বাঙালী স্বাধীনতার জন্য ক্ষুধার্থ ছিলো। ১৯৪৮ এরপর ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয়দফা কিংবা ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সব আন্দোলনের আড়ালে লুকায়ে ছিলো বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে যখন দেশ উত্তাল, ক্ষোভে ফুলে ফেঁপে উঠেছে ছাত্র সমাজ। পুলিশের গুলিতে নিহত আসাদের শার্ট নিয়ে মিছিলে নেমেছে তাজা প্রাণ। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মতিউর। ছুরিকাঘাতে নিহত হন রুস্তম। নাখালপাড়ায় ঘরের ভেতরে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় সেনা ও ইপিআরের বেপরোয়া গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মা আনোয়ারা বেগম। হত্যার মিছিল, রক্ত, জনরোষে ফুঁসে ওঠে ঢাকা। এমনি অগ্নিগর্ভ দিনের এক সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি দেয়াল ছেয়ে গেছে একটি কবিতার পঙ্ক্তিমালায়- 'এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়...।' প্রতিবাদী এই লাইন দুটো কবি হেলাল হাফিজের কবিতা 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়'র। এই কবিতাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা প্রথম কবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে আহ্বান জানানো হয় সশস্ত্র যুদ্ধের; এখনও এই কবিতা লাখো তরুণের রক্তে জাগায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও উন্মাদনা সহজ কথায় যা সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক। এই কবিতার মাধ্যমে কবি সমকালের সাথে চিরকালের সাঁকো তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদকে নিয়ে কালজয়ী কবিতা "আসাদের শার্ট" লিখেছেন কবি শামসুর রাহমান। কবিতায় কবি লিখেছিলেন 'আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;/আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ এই কালজয়ী কবিতার প্রেক্ষাপট জানান দেয় পাকিস্তান পতনের কথা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের উৎকণ্ঠাময় মূহুর্তগুলোতে পল্লী কবি জসীম উদ্দীন তাঁর কাব্যিক বুনোনে কবিতা গেঁথেছেন এদেশের মানুষ, ঐতিহ্য, মর্যাদা এবং সাংস্কৃতিক উন্মাদনা। তাঁর সুক্ষ্ম কাব্যিক বুনোনে প্রকাশ পেয়েছে বাঙালির হৃদয় আর্তি, ফুঁটে উঠেছে স্বাধীনতাকামী বাঙালির আর্তনাদ। একাত্তরের ভয়াবহতার মিশেলে সর্বমোট ১৮টি কবিতা নিয়ে সংকলিত হয়েছে তাঁর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কবিতা। এই সংকলনটিকে জাতীয় দুর্দিনে শিল্পীর সামাজিক দলিল বললেও ভুল হবে না। এ গ্রন্থের 'কবির নিবেদন' কবিতায় কবি তৎকালীন অস্থিরতার চিত্র বিদ্রোহী সুরে তুলে ধরেছেন।
" আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতার চাবি
তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া
তুমি বাংলা ছাড়ো "
কবি সিকান্দার আবু জাফর তাঁর 'বাংলা ছাড়ো' কবিতায় যে অগ্নিবার্তা দিয়েছেন তা মুক্তিযুদ্ধের সাথে দারুণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। কবিতার বিদ্রোহী ভাষা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ স্বাধীন করার স্পৃহা বাড়িয়েছে বৈ কমায়নি।
ভিন্নধারার কবি শহিদ কাদেরীও লিখতে ভুলে যাননি অন্যায়, অবিচার নিয়ে। তাঁর কবিতায় দৃপ্ত উচ্চারণ যোগ হয়েছে তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে। 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতার মাধ্যমে কবি শামসুর রাহমান স্বাধীনতার সুক্ষ্ম সৌন্দর্য, কষ্ট, শ্রম ফুঁটে তুলেছেন। কবি রফিক আজাদ 'একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ' কবিতায় বীরোচিত মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
বাংলাদেশের অন্যতম কবি আল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। তাঁর কবিতায় বাঙালির পরাধীনতার দীর্ঘকালীন দুঃসময়ের গ্লানি ফুঁটে উঠতে দেখেছি। নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, আহসান হাবীব, আবুল হাসান, আবু হেনা মোস্তফা, হাসান হাফিজুর রহমান, প্রেম ও দ্রোহের কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সহ নাম জানা, না জানা অসংখ্য দেশী-বিদেশী কবি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা লিখে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, অনুপ্রেরণার পাশাপাশি সন্মান জানিয়েছেন।
কালের সাক্ষী হিসেবে কবির এসকল কবিতার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, অনুমান করতে পারছে কবিতার শক্তি, মাহাত্ম। যুদ্ধের আগে ও পরের পরিস্থিতি, আশা আকাঙ্ক্ষার বীজ ফুটে উঠেছে কবির কবিতায়। মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্যিক ইতিহাস কবিতার মাধ্যমে বেঁচে থাকবে যত দিন বেঁচে থাকবে বাংলা সাহিত্য। কবিতার জয়গান বাজবে কাব্য প্রেমিকদের মুখে। মুক্তিযুদ্ধে কবিতার অবদান, ছোট ছোট মহাকাব্যিক পঙক্তির অবদান যেন একেকটা বুলেটের মতো। মুক্তিযোদ্ধাদের মননে নাড়া দেয়া কবিতা গুলো আমাদের দ্রুত স্বাধীনতা উপহার দিয়েছে বললেও ভুল বলা হবে না। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে কবিতা যুগের পর যুগ অণুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে আলো দিক এই প্রত্যাশা চিরকালের।
বিশাল সাহা
লেখক ও কলামিস্ট
১ দিন ৯ ঘন্টা ১০ মিনিট আগে
২ দিন ৯ ঘন্টা ১০ মিনিট আগে
৬ দিন ১৮ ঘন্টা ৪৫ মিনিট আগে
৯ দিন ২ ঘন্টা ৪৭ মিনিট আগে
১৫ দিন ১৪ ঘন্টা ৪৩ মিনিট আগে
১৬ দিন ৭ ঘন্টা ৪২ মিনিট আগে
১৭ দিন ৫ ঘন্টা ১৪ মিনিট আগে
১৮ দিন ৬ ঘন্টা ২৬ মিনিট আগে