◾ প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির প্রতীক । ষড়ঋতুর এমন দেশে প্রত্যেক ঋতু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই আবির্ভূত হয়। তার মধ্যে একটি ঋতু শীতকাল। পুরোদমে চলছে শীতকাল।ঋতুর পালাবদলে আমাদের সামনে উপস্থিত হয় শীত। শীত এলে অনিবার্যভাবেই প্রকৃতিতে ঘটে কিছু পরিবর্তন। নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে শুরু করেছে। গরম কাপড়ের অভাবে অসহায় মানুষগুলো রাতে ঘুমাতে পারে না। সমাজের উঁচুস্তরের মানুষজন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে একটু মমতার দৃষ্টি দিলে তারা আরামে ঘুমাতে পারে।শীতার্ত মানুষগুলো কতটা দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। তা শহর-নগরের ফুটপাত, রেলস্টেশনে না গেলে বুঝা মুশকিল।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে শীত বছর ঘুরে আসবে এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তবে শীতের দাপট সব বছর সমান হয় না। কোনো বছর বেশি, কোনো বছর অপেক্ষাকৃত কম। দেশজুড়ে শীতের মাস পৌষেই হিমেল হাওয়ায় প্রকৃতিতে নামে নীরবতা। নেমে আসে এক ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন শিশির সকাল কিংবা ভোর। কুয়াশাঘেরা বর্ণিল প্রকৃতিতে শীত আসে এক অন্যরকম আবেদন নিয়ে। এ সময় রসেভরা পিঠাপুলি আর পায়েসের উৎসবে মেতে ওঠে অনেকে। অবসন্ন কুয়াশা কিংবা মায়াময় রোদের আমেজ এ শীতেই ধরা দেয়।
শীতের সময় শহরাঞ্চলের মানুষদের তুলনায় গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। তারা যেখানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার কিনতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে উঠে, সেখানে শীতের বস্ত্র কেনা অসম্ভব। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন উত্তরাঞ্চলের অসহায় মানুষজন। শীতের সময় রংপুর বিভাগের জনগণ বেশি কষ্ট করে থাকে।
শীতে সবথেকে রংপুর বিভাগ ও বরিশাল বিভাগে মৃত্যুর হার বেশি। "ডেভেলপিং কোল্ড রিলেটেড মরটালিটি ডেটাবেজ ইন বাংলাদেশ" এর এক তথ্য মতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের প্রতি ১০ লাখে- রংপুর বিভাগে ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ২৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ, খুলনায় ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, চট্রগ্রামে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ময়মনসিংহে ২দশমিক ১৮ শতাংশ ও ঢাকা বিভাগে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ লোক মারা যায়।
এক গবেষণায় দেখা যায়,২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের শীত মৌসুমে মোট ১ হাজার ২৪৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এ সময় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১১-২০১২ সালের শীতে ২১৪ জন। সবচেয়ে কম মৃত্যু হয় ২০১৬-২০১৭ সালের শীতে ১৮ জন। ২০২০ ও ২০২১ সাল মিলিয়ে যে শীত মৌসুম, সে সময়ে মৃত্যু হয় ৫২ জনের। গবেষকেরা বলছেন, সাধারণত শীত বেশি পড়লে মৃত্যু বেশি দেখা যায়।মৃত্যুর বেশির ভাগ, ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ খেত্রের কারণ শীত। ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ঠাণ্ডায় রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কারণ। ৫ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হওয়া। শীতে মৃত্যু বেশি হয় শিশুদের। শীতের সময় শিশুরা বিভিন্নরকমের ঠান্ডা জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ২০২১ সাল পর্যন্ত আগে ১২টি শীত মৌসুমে যত মানুষ মারা গেছে, তার অর্ধেকের বেশির ( ৬৩৩) টির বয়স ৬ বছরের কম। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ মারা গেছেন ২৫৫ জন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বলে। আর তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, রাজধানীসহ সারাদেশে শীতের তীব্রতা বেড়েছে।
পৌষ মাস শেষ হয়ে মাঘ মাস এখনও শুরু হয়নি। গ্রামীণ জনপদে আক্ষরিক অর্থে মাঘ মাস আসে শীতের দাপট নিয়ে। আসলে পৌষ মাসের শুরুতেই উত্তরের বিভিন্ন জেলায় শীত জেঁকে বসা শুরু করে। শীতের তীব্রতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় মানুষের কষ্ট। হাড়কাঁপুনি শীতে গরীব মানুষের কষ্ট অবর্ণনীয়। শীতার্তদের কষ্ট লাঘবে সবচেয়ে যা জরুরি তা হল মানবিক সহায়তা, বিশেষত ছিন্নমূল দরিদ্র মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ করা।
রাতে কম্বল আর নকশিকাঁথা ব্যবহার করে অনেকে আরাম-আয়েশে ঘুমাচ্ছে। একটু খেয়াল করলে আমরা দেখব চারপাশে অনেক প্রতিবেশী আছে, যারা শীতে কষ্ট পাচ্ছে। যেসব অসহায় মানুষ শীতে কষ্ট পাচ্ছে, তাদের পাশে থাকাটাই মানবতা। উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের শীতের সময় খুব কষ্ট।
গ্রামের এসব মানুষের অনেকের পক্ষে আলাদাভাবে শীতের কাপড় কেনা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। প্রতি বছর শীতের সময় দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ে শীতার্ত মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। অতীতে সরকারি পর্যায়েও গরিব মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার সে ধরনের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। অন্যদিকে দেশে অস্বস্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাবের কারণে এক ধরনের জ্বরাগ্রস্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর প্রভাব সামাজিক কর্মকাণ্ডের ওপরও পড়ছে। কিন্তু সমাজের বিত্তবান ও মানবিক বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে মানুষের দুর্ভোগ শুধু বাড়বেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, করোনাকালে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আরো চাপে পড়েছেন ২০২২ সালে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ( ডব্লিউএফপি) গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ পরিবার খাবার কিনতেই হিমসিম খাচ্ছে। ফলে তাদের পক্ষে শীতের পোশাক কেনা কঠিন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো গরীব অসহায় মানুষদের শীতবস্ত্র বিতরণ করলেও এইবার তেমন একটা চোখে পড়ছে না।
নিম্ন-মধ্যবিত্তদের মধ্যে যারা লজ্জায় নাম প্রকাশ করতে পারছেন না। কৃষিক্ষেতে কাজ করেন বা দিনমজুর তাদের জন্য রাতের বেলায় কম্বলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সমাজের বিত্তবানরা চাইলেই ছিন্নমূল মানুষদের এ হাড়কাঁপানো শীতের সময় সাহায্য করতে পারেন। একটু সহযোগিতার মাধ্যমেই সমাজে বসবাসরত গরিব অসহায় মানুষগুলোর মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
ছিন্নমূল মানুষগুলো শুধু শীতের সময় কষ্ট পায় না, গরিবের দাবদাহ ও বর্ষার অঝোর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জীবননাশের পরিক্রমায় পরিণত হয়ে পড়ে। দেশের নিন্মাঞ্চলের মানুষগুলো বর্ষাকালে আশ্রয়স্থল, খাবাবের সংকটে পড়ে। তাদের বেঁচে থাকা অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়।এ ক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি থেকে শীতার্তদের রক্ষা করা যায়। শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করি।
আমরা শীতার্ত মানুষের জন্য মানবিক হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসি। আসুন, একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি। শীতকে জয় করে অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাই।
• প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল
লেখক ও সংগঠক
১ দিন ৯ ঘন্টা ১৪ মিনিট আগে
২ দিন ৯ ঘন্টা ১৫ মিনিট আগে
৬ দিন ১৮ ঘন্টা ৫০ মিনিট আগে
৯ দিন ২ ঘন্টা ৫১ মিনিট আগে
১৫ দিন ১৪ ঘন্টা ৪৮ মিনিট আগে
১৬ দিন ৭ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
১৭ দিন ৫ ঘন্টা ১৮ মিনিট আগে
১৮ দিন ৬ ঘন্টা ৩১ মিনিট আগে