স্বল্পমেয়াদি সংস্কারে সম্মত হলে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে কার ওপর ক্ষোভ ঝাড়লেন স্বস্তিকা হেদায়েতের জন্য দোয়া করা কুষ্টিয়ায় সাহেরা খাতুন ফাউন্ডেশন ও হাজ্বী নায়েব আলী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কর্তৃক শিক্ষা উপকরণ বিতরণ বাঘায় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে-১০৪৩ কেজি টিসিবির পণ্য চুরীর অভিযোগ চিলমারীতে গাজায় গণহত্যা প্রতিবাদে সাংবাদিক ফোরামের বিক্ষোভ মিছিল একজন জনপ্রিয় অধ্যাপক এবং আদর্শ বাবার শেষ পরিণতি দৃঢ়ভাবে আগাও - নূরুল ইসলাম নাযীফ ফিলিস্তিন - শাহীন খান রাজশাহী বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার্থী কমেছে ১৯ হাজার রাজশাহী কলেজে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলন করে ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ নরসিংদী কমিউটার ট্রেন ঘোড়াশাল স্টেশনে স্টপেজ দেওয়ায় পলাশের জনমনে স্বস্তি লালপুরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতিমূলক সভা উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নাগেশ্বরীতে প্রস্তুতি সভা জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নন্দীগ্রামে বগুড়া হাইওয়ে পুলিশ সুপারের পথসভা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির বৈঠক ১৬ এপ্রিল নন্দীগ্রামে নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত ধানের শীষ যার হাতে আমরা থাকবো তার সাথে: মতবিনিময় সভায় সাবেক এমপি মোশারফ পলাশে অবৈধভাবে মাটি কাঁটায় চার জনকে সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক মামলায় আবারও কারাগারে সাবেক এমপি আজিজ

সাতক্ষীরায় উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের লবণাক্ততায় নারীরা হারাচ্ছেন জরায়ু

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বেড়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। আর মাত্রাতিরিক্ত এসব লোনা পানির দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে জরায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব এলাকার নারীরা। সেজন্য অল্প বয়সেই জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন এই এলাকার অনেক নারীই।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ৯ নম্বর সোরা গ্রামের আসমা বেগম (৩০)। সাত বছর আগে মাত্র ২৩ বছর বয়সে অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু কেটে ফেলেন তিনি বলেন, ছোট থেকেই আমার ধাতুর (সাদাস্রাব) সমস্যা ছিল। বিয়ের পরে প্রথম সন্তান জন্মের পর থেকেই জরায়ুতে জ্বালা-পোড়া ও যন্ত্রণা হতো। একে একে তিন সন্তান জন্মের পর জানলাম জরায়ুতে ঘা হয়েছে। তখন অবস্থা খুব খারাপ ছিল। পরে খুলনার এক হাসপাতালে ভর্তি হলে অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেন ডাক্তার।

তিনি বলেন, আমার বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি গাবুরা ইউনিয়নেই। ফলে জন্ম থেকেই লোনা পানির সাথে বসবাস। তবে আগের তুলনায় যেন লোনাভাব বেড়েছে। গরমকালে লোনাভাব এত বাড়ে যে, পুকুরের পানি মুখেই নিতে পারি না। অথচ তাতেই গোসলসহ সব কাজ করতে হয়। আসমার চেয়ে কম বয়সে জরায়ু ফেলতে বাধ্য হয়েছেন তার প্রতিবেশী রওশন আরা পারভীন (২৭)। তার গল্পও একই রকম। প্রায় বছর চারেক আগে জরায়ুতে টিউমার দেখা যায়। সে কারণে পুরো জরায়ু ফেলে দেয়া হয় তার। জরায়ু অপারেশনের পর দুজনেরই স্বামী তাদের ফেলে অন্যত্র বিয়ে করেছেন।

শুধু গাবুরা নয়, উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরের প্রতিটি গ্রামে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নারীদের জরায়ু সংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লোনাপানিপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি। আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের রুইয়ার বিলের বাসিন্দা আমিনা বেগম (২৮) জাগো নিউজকে বলছিলেন, আমার তলপেট খুব ব্যথা করে, কোমরের অংশ অবশ হয়ে যায়, মনে হয় পেটের ভেতর থেকে কিছু একটা ছিঁড়ে নিচে নেমে আসছে। তাছাড়া প্রচণ্ড সাদাস্রাব হয় আর চুলকায়। ঘণ ঘণ প্রস্রাব হয়। আর প্রসাব করতেও খুব কষ্ট হয়।

‘গ্রামের ডাক্তাররা জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শও দিয়েছেন। কিন্তু এই বয়সে অপারেশন করাতে স্বামী রাজি হননি। আপাতত চিকিৎসা নিচ্ছি। কিন্তু খুব বেশি হলে ১০-১৫ দিন ভালো থাকি।’

শ্যামনগরের তিনটি বেসরকারি ক্লিনিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরে মোট অপারেশনের প্রায় ১০ শতাংশ রোগীর জরায়ু অপারেশন হয়ে থাকে। এসব ক্লিনিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জরায়ু ফেলে দেয়ার হার বেশি।

বার্ষিক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে সুন্দরবন নার্সিং হোমে শতকরা ৫ জন রোগীর জরায়ু অপারেশন হয়েছে। একই বছরে নগর ক্লিনিকে রোগীদের প্রায় ৮ শতাংশের হয়েছে জরায়ু অপারেশন। এছাড়া বংশিপুর ক্লিনিকে শতকরা ১১ জনের হয়েছে জরায়ু অপারেশন।

শ্যামনগরের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে এ প্রতিবেদক অন্তত ৬০ জন নারীর সাথে কথা বলেছেন, যারা জরায়ু সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন। এদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনের ইতোমধ্যে অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেয়া হয়েছে। বাকিরা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। কেউ কেউ জরায়ু ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে জরায়ু সমস্যায় ভুগতে থাকলে তা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

শ্যামনগরে অবস্থিত ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জরায়ুর অসুখের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে ৩৮০ জন নারীর ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এদের মধ্যে ২৩ জনের ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তাদের দুইজনকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাকিদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়।

শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তাসনুভা আফরিন দেশচিত্র প্রতিবেদকে বলেন, হাসপাতালে আমি মাসে গড়ে প্রায় নয়শ’ রোগী দেখি। এদের মধ্যে ১০-১২ জন রোগী পাই যাদের জরায়ু ফেলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া জরায়ু সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যাও তুলনামূলক বেশি। ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে জরায়ু কেটে ফেলাটাকেই তারা সমাধান মনে করেছেন। কিন্তু এর ফলে তাদের শারীরিক সমস্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে। অনেকের সংসারই ভেঙে যায়। হট ফ্লাস (হাত-পা ও শরীর জ্বালা-পোড়া), অল্পতে উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার মতো অসুবিধা হতেই থাকে’—বলেন তিনি।ডা. তাসনুভা অবশ্য মনে করেন, জরায়ু সংক্রান্ত রোগের সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। এ এলাকার নারীরা সঠিক গাইডলাইন না পাওয়ার কারণেই জরায়ু ফেলে দিতে বাধ্য হন। ২০১৮ সালে ‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততার প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় লবণ পানিতে ধুয়ে আবারও সেটি ব্যবহার করে। এর ফলে নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয় তারা।

জানা যায়, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব এবং গোসলসহ দৈনন্দিন কাজে অপরিচ্ছন্ন ও মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানির ব্যবহারের ফলে লিউকোরিয়ায় ভুগছে শিশু থেকে কিশোরী এবং নারীরা। যা ধীরে ধরে জরায়ু ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার রেশমা আক্তার বলেন, এখানকার প্রায় প্রতিটি নারী ও শিশু সাদাস্রাব সমস্যায় ভোগে। ২-৩ বছর বয়সী মেয়ে শিশুরও নিয়মিত সাদাস্রাব হয়। এছাড়া মেয়েরা জরায়ু সংক্রান্ত সমস্যা, রক্তস্বল্পতা, আমাশয়, চর্মরোগ, ডিসমেনোরিয়া (অস্বাভাবিক মাসিক) রোগের ওষুধ নিতে বেশি আসে।

‘সাদাস্রাব বা জরায়ুর কোনো সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেই তিনি পুকুরে নেমে গোসল না করার পরামর্শ দেন। কিন্তু যেখানে এক পুকুরে অন্তত ৬০-৭০ জনের গোসল করতে হয় সেখানে এই নিয়ম মানার সুযোগ কোথায়? তাই শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সব মেয়েরা এখন এই সমস্যাকে নরমাল ব্যাপার ধরে নিয়েছে’—বলছিলেন বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের গৃহিণী জোৎস্না রাণী (২৬)। চিকিৎসকদের মতে, নিয়মিত সাদাস্রাব এবং নোংরা পানিতে গোসলের কারণে মেয়েদের জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 চিকিৎসক ডা. তাসনুভা দেশচিত্র প্রতিবেদককে  বলেন, শিশুবয়স থেকে দীর্ঘদিন ধরে সাদাস্রাব বা লিউকোরিয়ার কারণে মূত্রনালীর সংক্রমণ, শ্রোণী (পেলভিস) প্রদাহজনক সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব এমনকি সার্ভিকাল ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

‘প্রাপ্তবয়স্কদের লিউকোরিয়ার নানা কারণ আছে। কিন্তু শিশুদের সাদাস্রাবের কারণ হতে পারে পানি কম খাওয়া, এক পুকুরে অনেক মানুষ গোসল করা, অপরিচ্ছন্ন থাকা, কৃমি, অপুষ্টি, ইত্যাদি’—বলেন ডা. তাসনুভা।

দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলের রোগীদের সেবা দেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, পানির সঙ্কটের কারণে এক পুকুরে অন্তত ২-৩শ’ মানুষ গোসল করেন। আবার সেখানে হাঁস এমনকি গরু-ছাগলের গোসলও করানো হয়। ফলে এই রোগের সংক্রমণ বাড়তে থাকে। আবার দারিদ্র্য ও অশিক্ষার কারণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়েও তারা সচেতন নন।

গাবুরা এবং বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ১৫ জন কন্যাশিশুর অভিভাবক জানান, ২-৩ বছর বয়স থেকেই তাদের সাদাস্রাবের সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া এসব এলাকার ১৫ জন কিশোরীও একই সমস্যার কথা জানায়। রয়েছে অনিয়মিত মাসিকের সমস্যাও।

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন শাফায়াত বলেন, শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকায় লোনা পানির কারণে মেয়েদের লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণ বেশি। দেশের অন্যান্য এলাকায় মেয়ে শিশুর লিউকোরিয়ার সমস্যার কথা শোনা যায় না। এটা এই অঞ্চলেই বেশি। লোনা পানির ব্যবহার এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবেও এটা হতে পারে।

শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকের বলেন, আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সংকট তো আছেই বিশুদ্ধ পানির জন্য গভীর নলকূপের বসানোর ইচ্ছা আমাদের আছে । কিন্তুু আমাদের ইউনিয়ন পরিষদে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও প্রকল্পের অর্থ না পাওয়াই গভীর নলকূপ বসাতে পারছি না। এজন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে।

Tag
আরও খবর