◾নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার : শিক্ষার আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে প্রয়োজন তা হলো বিনিয়োগ। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে সেই বিনিয়োগই আজ অধরা। এই বিনিয়োগকে কেবলই আমরা অর্থের দৃষ্টিতে দেখছি না। তবে হ্যাঁ অসংগতির সবচেয়ে বড় যে জায়গাটি সেটি হলো আর্থিক অসংগতি । সম্প্রতি মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবীতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ব্যানারে টানা ২৩ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করেন মাধ্যমিকের এমপিওভূক্ত শিক্ষকরা। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ইতোমধ্যে শ্রেণিকক্ষে ফিরেছেন মাধ্যমিকের শিক্ষকরা। সরকারের আশ্বাসে তারা শিক্ষার্থীদের পড়ানোতে মনোনিবেশ করেছেন। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মেছে যে সরকার হয়তো নির্বাচনের আগে তাদের দাবীর প্রতি নজর দিবেন। দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শিক্ষকদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তাদের আশা , শিক্ষকগণের দাবি এবং বৈষম্য নিরসনে প্রধানমন্ত্রী দ্রুতই পদক্ষেপ নেবেন। এই আন্দোলন নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা সমালোচনা জন্ম নিয়েছে। কেউ বলছে এই দাবী অযৌক্তিক আবার কেউ বলছে এদের দাবী সবার আগে পূরণ করা প্রয়োজন। আমরা যে আন্দোলনটা দেখেছি তা কেবল মাধ্যমিকের আন্দোলন নয় সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে এ আন্দোলন হলো এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের আন্দোল প্রত্যাহার করতে বললেও আন্দোলন প্রত্যাহার হয়নি। তারা চেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সাথে পাঁচ মিনিটের সাক্ষাত কিন্তু হয়নি। তাই আন্দোলন আরো বেগবান হতে থাকে। যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের সাথে সকল পক্ষই যোগ না হলেও অন্তরের কামনা ছিল তারা যেন সফল হয়। পরবর্তী সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামীলীগের কার্যালয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সাথে বৈঠকে বসে শিক্ষক নেতারা। বৈঠকে শিক্ষকদের জাতীকরণের আশ্বাসে অনশন স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েমনের (বিটিএ) নেতারা। এবারের আন্দোলনের সময় এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের যেভাবে সমালোচনা করা হয়েছে সেটা আসলেই ঠিক নয়। বিশেষ করে এনটিআরসিএ কর্তৃক পরীক্ষা নেয়ার পর থেকে শিক্ষক নিয়োগে মানের পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে যেভাবে নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে তার চেয়ে বরং আরো স্বচ্ছ এবং ভালোভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। ভালো শিক্ষার্থীরা যেন এ নিয়োগ পরীক্ষায় আগ্রহ দেখায় সে ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক যোগদানের সময় জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫শ টাকা বেতন, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫শ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং ২৫% উৎসব বোনাস পেয়ে থাকে। এছাড়া ২০% বৈশাখি ভাতা সাথে যুক্ত হয়েছে। এখান থেকে আবার কর্তন করা দুটি ফান্ডে ১০%। অন্যদিকে সরকারি ফশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতো সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে যদিও তাদের কার্যক্রম একই। সবকিছু একরকম থাকার পরও সরকারের পক্ষ থেকে বিমাতাসূলভ আচরণ সরকারি ও এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের মাঝে বিভেদ তৈরি করছে। বর্তমান সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারি সমাজ হচ্ছে শিক্ষক। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষককে এক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু মুখে মুখে স্মার্ট শব্দ বলে বেড়ালেই চলবে না। কার্যকারি পদক্ষেপ নিতে হলে শিক্ষকদের দিকে তাকাতে হবে। শুধুমাত্র আর্থিক দিকে নজর দিলেই চলবে না। শিক্ষকদের আগে স্মার্ট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের দাবী একই পাঠ্যক্রমে সকল শিক্ষকই অন্তর্ভূক্ত থাকলেও বেতনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য তা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ থেকে বেরিয়ে না আসলে শিক্ষকরা তাদের সবটুকু উজাড় করে দিতে পারবে না। তাদের এ কথাটি একটু ভাবলেই সত্যতা পাওয়া যায়। একটা সময় নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা থাকলেও বর্তমান সময়ে এসে এটা নেই বললেই চলে। যারা পূর্ববর্তী সময়ে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিল তারা এখন অভিজ্ঞতার আলোকে সে পথ অতিক্রম করেছে। এমপিওভূক্ত শিক্ষায় সমতাকরণ না হওয়ায় শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে একথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। একটি জাতিকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে যেতে হলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় শিক্ষায় । কিন্তু আমরা তা পারছি না যার ফলে মেধাবীদের এ পেশায় আনার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। যার ফলে মেধাবীদের দিন দিন অন্যান্য পেশায় চলে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। উদাহরণ স্বরুপ যদি আমরা দেখি, কোন ক্লাসে গিয়ে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তোমরা কে কে শিক্ষক হতে চাও তখন কারো হাত উঠে না। দেশের ক্যাডার সার্ভিস পরীক্ষায়ও আমরা দেখে থাকি মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে পছন্দ না দেয়া। সত্যিকার অর্থে স্বাধীন জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য লজ্জাকর। বিভিন্ন সংবাদে চোখ রাখলেই দেখা যায় কি পরিমাণে মেধা পাচার হচ্ছে আমাদের দেশ থেকে। এর প্রকৃত কারন হলো আমরা মেধাকে লালন করতে পারছি না। আমাদের বাজেটে যে পরিমাণে বরাদ্ধ রাখা হয় তা দিয়ে মেধাবী জাতি গঠন করা কঠিন। তাই দেশের ভাগ্যোন্নয়নে ও জনশক্তিকে স্মার্ট জনশক্তিতে রুপান্তরিত করার জন্য শিক্ষায় বরাদ্ধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এবং এই বরাদ্ধের মধ্যে এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের বরাদ্ধ বৃদ্ধি করে সরকারি ও এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের মাঝে সমতা বৃদ্ধি করা জরুরি কারন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমপিওভূক্ত শিক্ষা একটি বড় স্থান দখল করে রয়েছে। প্রায় সময়ই দেখা যায় শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠন ক্লাস রেখে রাস্তায় নেমে আসে তাদের দাবী আদায়ের জন্য। এই রাস্তায় নামার ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝেও শিক্ষক ও এ পেশা সম্পর্কে একটি নেগেটিভ ধারণার জন্ম নেয়। সুতরাং এই সমস্যার সমাধান কল্পে সরকারকে এগিয়ে এসে এটাকে বিনিয়োগ হিসেবে নিতে হবে। শুধু মাত্র সক্ষমতার দোহাই দিয়ে স্বাধীনতার এত বছর পার করা হয়েছে। শিক্ষা হচ্ছে এমন একটা জায়গা যা কখনও জোড়াতালি চালানো সম্ভব নয়। সরকারের পক্ষ থেকে দেখছি দেখবো এসব ভাষা ব্যবহার করা হয় সবসময় কিন্তু শিক্ষা এভাবে চলতে পারে না। আজকে যারা দেশ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছে তারাও কিন্তু লেখাপড়া করেই আসছেন এবং বেশির ভাগই এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে কিন্তু তারা সেসব মনে রাখেনি। তারা এখন এ শিক্ষাব্যবস্থাকে সুন্দর করার দায়িত্ব না নিয়ে শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। এমপিওভূক্ত শিক্ষকের আরেকটি জটিল সমস্যা হলো অবসরের পরবর্তী সময়। সারা জীবন শিক্ষার পেছনে ব্যয় করলেও রাষ্ট্র তাদের পরবর্তী জীবনের প্রকৃত অধিকারটুকু দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষকের অবসরের সুবিধাটুকু পেতে পেতে চলে যেতে হচ্ছে পরপারে। চাকুরি শেষে আর্থিক প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে সেসময় তাদের প্রাপ্য টাকাটা সঠিক সময়ে তাদের হাতে তুলে দেয়া যাচ্ছে না। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেয়া বর্তমান সময়ের দাবী।
লেখক পরিচিতি
প্রাবন্ধিক
২ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
২ ঘন্টা ২০ মিনিট আগে
২ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে
৪ ঘন্টা ১৬ মিনিট আগে
৪ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
৬ ঘন্টা ১১ মিনিট আগে
৮ ঘন্টা ২৩ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ৪৩ মিনিট আগে