রবিবার ৭ জুলাই শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথ যাত্রা।‘রথযাত্রা’র ‘যাত্রা’ শুধু দেবতার নয়, ভক্তেরও। দেবতার প্রতি ভালবাসার টান থেকেই তো ভক্ত তাঁর রথকে নিয়ে এগিয়ে চলেন। শ্রীচৈতন্যের সময় থেকেই বাঙালির সঙ্গে রথের যোগাযোগ আরও গাঢ় হয়েছে।সনাতন ধর্মাল্বামীরা এ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকেন।রথযাত্রার ইতিহাস টা হয়তো অনেকের অজানা, স্কন্দ পুরানে আমরা পাই যে ইন্দ্রদ্যম্ন নামে এক রাজা ছিলেন উত্কল রাজ্যে (বর্তমানে যা উড়িষ্যা)। তিনি ছিলেন একজন পরম ভক্ত। একদিন স্বপ্নাদিষ্ট হন একটি মন্দির নির্মানের জন্যে ।পরে দেবর্ষী নারদ এসে জানন স্বয়ং ব্রহ্মার ও তাই ইচ্ছা, তিনি নিজে সেটা উদ্বোধন করবেন। এভাবে কাজ হল এবং নারদ বললেন বহ্মাকে আপনি নিমন্ত্রন করুন। পরে রাজা ব্রহ্মলোকে গেলেন এবং নিমন্ত্রন করলেন । কিন্তু ব্রহ্ম লোকের সময় এর সাথে তো পৃথিবীর মিল নাই । পৃথীবিতে কয়েক শত বছর পার হয়ে গেছে । ফিরে এসে রাজা দেখলেন তাকে কেউ চেনে না । যা হোক তিনি আবার সব করলেন । দৈবভাবে রাজা জানতে পারলেন সমুদ্র সৈকতে একটি নিম কাঠ ভেসে আসবে , সেটা দিয়েই তৈরি হবে দেব বিগ্রহ ।এদিকে মূর্তি তৈরি শুরুর কিছু দিন পর রানী কৌতুহল সংবরন করতে না পেরে মন্দিরে যান এবং দেখেন কেউ নেই ভিতরে আর আমরা যে রূপে এখন জগন্নাথ দেব কে দেখি সেই মূর্তিটি পড়ে রয়েছে । পরে ঐ ভাবেই স্থাপিত হয় মূর্তি । ইন্দ্রদুম্ন রাজা জগন্নাথ দেবের মূর্তিতেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।পরবর্তিতে শ্রীকৃষ্ণ এবং জগনাথ দেব একই সত্ত্বা চিন্তা করে একই আদলে তার পাশে ভাই বলরাম এবং আদরের বোন সুভদ্রার মূর্তি স্থাপন করা হয় । আমাদের এখানে এক রথ যাত্রা হলেও পুরিতে তিনটি রথে হয় । প্রথমে বলরাম তার পর সুভদ্রা এবং শেষে জগন্নাথ । ১১৯৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজা অনঙ্গভীমদেব তিন রথের রথ যাত্রা প্রচলন করেন । কঠোপনিষদে বলা হয়েছে না আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেবতু। এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। আর ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। রথ যাত্রার রুপক এমনই। তিনি আমাদের অন্তরে থাকেন। তার কোন রুপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজিত অর্থাত্ ঈশাব্যাসমিদং। বেদ বলছে আবাঙমানষগোচর, মানে মানুষের বাক্য এবং মনের অতিত । আমরা মানুষ তাই তাকে মানব ভাবে সাজাই।শ্রীমদ্ভাগবতে আছে ,যে ব্যক্তি রথে চড়ে জগন্নাথদেবকে বিশ্বব্রহ্মান্ড দর্শন করাবেন অথবা শ্রী ভগবানের রূপ দর্শন করাবেন ভগবান তাদের প্রতি অশেষ কৃপা বর্ষণ করেন।বৃহন্নারদীয় পুরাণে আছে,ভগবান নারায়ন লক্ষ্মী দেবীকে বলেছেন, ” পুরুষোত্তম ক্ষেত্র নামক ধামে আমার কেশব-মূর্তি বিরাজমান । মানুষ যদি কেবল সেই শ্রীবিগৃহ দর্শন করে তবে অনায়াসে আমার ধামে আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন। ” এছাড়া বিষ্ণুপুরাণেও এর মহিমা ও পুণ্যফলের কথা বিধৃত হয়েছে।বৃন্দাবনে গোপীরা একদিন কৃষ্ণের লীলা ও তাঁদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা আলোচনা করছিলেন। কৃষ্ণ গোপনে সেই সকল কথা আড়ি পেতে শুনছিলেন। তখন গোপীরা কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে দিয়েছিলেন যখন গোপীরা কৃষ্ণ নিয়ে আলোচনা করবেন তখন কৃষ্ণ যাতে তাঁদের কাছে আসতে না পারে । সেদিকে নজর রাখবে সুভদ্রা।এদিকে গোপীদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা শুনতে শুনতে দেখে এতই বিমোহিত হয়ে পড়েন যে ভুলে যান তাঁর নিজ কর্তব্য। ফলে তাঁর দুই দাদা কৃষ্ণ ও বলরাম এগিেেযে এলেও তিনি খেয়াল করেননি। এদিকে গোপীদের কথা শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ৈ কেশ খাড়া হয়ে উঠল, হাত গুটিয়ে আসে, চোখ দুটি বড় বড় হেেযে যায় এবং মুখে আনন্দের উচ্চ হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এই কারণেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এমন রূপ ।বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের এই বিমূর্ত রূপটিকে পূজা করে থাকেন। ফলে সেই মতো মূর্তি দেখাই তা অনেকের অসম্পূর্ণ বলে মনে করছেন৷এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন।পরবর্তীকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন। ‘উৎকলখন্ড’ও ‘দেউল তোলা’ নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস রয়েছে,এই ছিল রথযাত্রাকে ঘিরে সকল লোকবিশ্বাস বা পুরাণে বর্ণিত পবিত্র গাথা। কাহিনি অনুযায়ী, জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথকে স্নান করানো হয়। তার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পর প্রায় ১৫ দিন জগন্নাথকে একান্তবাসে রেখে তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলা হয়। আষাঢ় মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ সুস্থ হয়ে একান্তবাস সমাপ্ত করেন এবং সকলকে দর্শন দেন। জগন্নাথের দেখা পেয়ে সকলে আনন্দিত হয়ে রথযাত্রার আয়োজন করেন।অন্য এক পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী সুভদ্রা দ্বারকা দর্শনের ইচ্ছা প্রকট করলে কৃষ্ণ ও বলরাম পৃথক পৃথক রথে বসে নগর ভ্রমণে বের হন। মনে করা হয়, এর পর থেকেই প্রতি বছর রথ যাত্রা আয়োজিত হয়।আর এক প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ইহলোক ত্যাগের পর কৃষ্ণের সঙ্গে বলরাম ও সুভদ্রার পার্থিব শরীর সমুদ্র তীরে দাহ সংস্কার করা হয়। সে সময় সমুদ্রতীরে ঝড়ের বেগে দ্বারকাধীশের অর্ধদগ্ধ শব সমুদ্রে প্রবাহিত হয়ে পুরী পৌঁছয়। পুরীর রাজা সেই তিন শব তুলে পৃথক পৃথক রথে বিরাজমান করান। নগরের লোকেরা নিজে সেই রথ টেনে সারা নগর ঘোরান। দারু কাঠ শবের সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে এসেছিল সেই কাঠ দিয়ে বাক্স তৈরি করে তাতে শব রেখে ভূমিতে সমর্পিত করে দেওয়া হয়। চারণ পুস্তক অনুযায়ী এর পর থেকেই প্রতি বছর রথযাত্রা পালিত হতে শুরু হয়।রথযাত্রার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। রথযাত্রার দিন শ্রী জগন্নাথের নাম, জপ করে গুন্ডিচা মন্দিরে যান। তিনি সকল কাজেই এগিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, রথের দড়ি ধরে যিনি টান দেন তার মনে সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয়। ভগবানের বিশেষ কৃপা তিনি লাভ করেন। রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করলে শিশুদের যাবতীয় সমস্যা দূর হবে।পুরী ছাড়াও বিশ্বের অনেক হিন্দু এলাকাতেই রথ উৎসব পালন করা হয়। যেমন, নিউ ইয়র্ক, টরেন্টো, লাওস সহ বাংলাদেশেও রথ উদযাপন হতে দেখা যায়। যেমন বাংলাদেশের সাভারের ধামরাইয়ে। এখানে প্রতি বছর ধুমধাম করে পালন করা হয় যশোমাধবের রথযাত্রা। এছাড়া, টাংগাইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, দিনাজপুর, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম,সাতক্ষীরা,খুলনা ইত্যাদি জেলাতেও বড় করে পালিত হয় রথযাত্রা। এতে অংশ নেয় ধারের কাছের গ্রাম, উপজেলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এবং উপভোগ করতে আসে সকল ধর্মেও মানুষই। রথকে কেন্দ্র করে চমৎকার মেলা বসে বিভিন্ন স্থানে। রথের সাথে কলা বেচা ও লটকনের বিশেষ সম্পর্ক আছে। তাই প্রচুর কলা ও লটকন কেনাবেচা হয় রথে। শুকনা খাবার, যেমন- খই, মুড়ি-মুড়কি, চিরা ভাজা, জিলাপী, আমিত্তি ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। শুধু এগুলোই নয়, হাতে তৈরি মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, কাপরের পুতুল, বাচ্চাদের খেলনা, তৈজসপত্র, কাঠের ঠাকুরঘর আরও নানা রকম সামগ্রীও পাওয়া যায় রথের মেলাতে।রথযাত্রা শুধু উৎসব বা মেলা নয় রথ গতি ও এগিয়ে চলার প্রতীক। (সূত্র:বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ){সচ্চিদানন্দদেসদয়,সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী}
৩ ঘন্টা ২৫ মিনিট আগে
৩ ঘন্টা ২৯ মিনিট আগে
৪ ঘন্টা ২১ মিনিট আগে
৪ ঘন্টা ৫৮ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ০ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ১ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ২ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ৬ মিনিট আগে