সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় হাজারো মানুষের বসবাস। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে দেখা দেয় প্রচন্ড খরা। বিশেষ করে নভেম্বর মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত তেমন কোন বৃষ্টিপাত হয় না। এ সময় ফেব্রুয়ারী থেকে প্রায় জুন মাস পর্যন্ত তেমন ফসলের অঞ্চলের চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না।
এই অঞ্চলগুলোতে বিশেষ করে কৃষির জন্য বড় বাধা হলো লবণাক্ততা, জোয়ার ভাটা নদী ভাঙ্গন, অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ও লবণ পানির চিংড়ি চাষ । উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে মিষ্টি পানির অভাব এবং ব্যাপকভাবে কৃষি জমিতে চিংড়ি চাষের কারণেই কৃষি জমির সংকট দেখা দিয়েছে। বলা যায়, সংকটের ইতিহাসে এ অঞ্চলে নদীকে ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় আয়োজন হলো ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ।
আবহমানকাল ধরে জোয়ার ভাটার সাথে আশা পলি উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি গঠন করতো। জোয়ার ভাটার প্রবাহ নদী সমুহের নব্যতা ধরে রাখতো। এই প্রবাহের কারণে নদীর গতি পথ পরিবর্তন না করলে নদীর প্রশস্থ গভীরতা স্বাভাবিক প্রকৃতিকগত কারণে নদী মরে যাওয়ার ঘটনা বিরল। উপকূলের মানুষ এক সময় অষ্টমাসী বাঁধ দিয়ে ধান চাষ করতো। পরবর্তী সময়ে বাঁধ কেটে দিয়ে বাকি সময়ের জোয়ার ভাটায় পলি জমাতো কৃষি জমিতে। ষাটের দশকে উপকূল বাঁধ নির্মাণ হওয়ার পরে উপকূলের নদী কেন্দ্রিক সভ্যতার বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকে। সে কারণে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। লবণাক্ততার কারণ দেখিয়ে ৯০ এর দশক থেকে রমরমা চিংড়ি চাষ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে কৃষি জমির সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়ন, লবণ পানি সম্প্রসারণ করিয়ে কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে চিংড়ি চাষসহ শিল্প কলকারখানা ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক খামার। এ সকল দৃশ্যমান কর্মকান্ডের কারণে উপকূলে কৃষি জমি হুমকিতে পড়েছে। উপকূলে কৃষিজমি সংকটের কারণে এলাকা ভিত্তিক শতশত পরিবার কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছে। নদী ভাঙ্গনের কারণে গৃহীন হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার।
চিংড়ি খামার ও অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক খামারগুলো তৈরীর কারণে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম আয়ের কৃষকরা বাধ্য হয়েছে কৃষি জমি হারিয়ে বিকল্প পেশায় কাজের সন্ধানে শহরে ভ্যান রিক্সাসহ ও ইট ভাটায় যেতে। নদী ভাঙনের কারণে কৃষি জমি ও বসতভিটা ছেড়ে যাওয়া মানুষের কথা জানালেন বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দুর্গাবাটী গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য নীলকান্ত রপ্তান বলেন, আমাদের এলাকায় চিংড়ি চাষের কারণে নদীর বাধে দেখা দিয়েছ ভাঙ্গন। আমাদের সময় যখন ধান চাষ করতাম, সে সময় কোন নদী ভাঙন ছিল না। এখানে নাইনটি বসানো হয়েছে, এমনকি রাস্তা ছিদ্র করে গেট করা হয়েছে। নদীতে লবণ পানি ও চিংড়ি ঘেরে লবণ পানি থাকার কারণে বেড়িবাধের মাটির ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। আমাদের এখানে প্রতিবছর ভেঙে যায়, আমাদের প্রাইমারি স্কুল একটি মন্দির একটি খেলার মাঠ, সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের পশ্চিম দুর্গাবার্টি প্রায় শতাধিক পরিবারের জমি ভেঙ্গে নদীর ওপারে চরে জেগে উঠেছে। আমার শুধু একটা ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই সব নদীগর্ভে নিয়ে গেছে। স্থায়িত্বশীল বেড়িবাঁধ নির্মাণে বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও কৃষি জমি হারিয়ে যাদের জমির উপর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে তারা আজ উপেক্ষিত।
উপকূলের বেড়ীবাঁধ ভেঙে লবণ পানি প্রবেশ করার কারণে কৃষি জমি নষ্ট, কৃষি কাজের ক্ষেত্র কমে গিয়েছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন-১ বোর্ডের কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, শ্যামনগর উপজেলার বেড়ীবাঁধের পরিমাণ হল ১৪৩.৬৬০ কিলো মিটার। এর মধ্যে পদ্মপুকুর ইউ পিতে ৭/১ নং পোল্ডার যে টি আশাশুনি উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ করেন। এছাড়া ৫, ৭, ১৫ নং পোল্ডার এর সংগ্রহ উপকুল বাঁধে সংস্কার এবং ডেল্টা প্যান নিয়ে বড় পরিকল্পনায় কাজ চলমান। শুধুমাত্র বেড়িবাঁধে ভাঙ্গনের কারণেই বেশি মানুষ স্থানান্তরিত হয়েছে তা নয়। এখানে লবণাক্তার প্রভাব এবং কৃষি জমি ও কাজের ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় মানুষ সেখান থেকে চলে গেছে। তিনি আরো বলেন, বেড়িবাঁধ রক্ষার্থে আগামী ৫০ বছরের জন্য একটি বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নদীর গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য নদীর ড্রেসিং জরুরী। সাধারণ কৃষি ভূমি ছাড়া নদীর মোহনা বেশ উঁচু হয়ে গেছে, সে কারনে পানি ধারণ ক্ষমতার চেয়ে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে প্রতিবছর এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের আতঙ্কে থাকতে হয়।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী নজরুল বলেন, আমাদের ইউনিয়নের ১৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পশ্চিম ও পূর্ব দুর্গাবার্টি এখানে বাঁধের পাড়ের মানুষের সব সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণ পানি লোকালয়ে প্রবেশ করবে এমন আতঙ্কে থাকতে হয়। পাউবো বাঁধগুলি সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের কোন কাজ করার সুযোগ থাকে না, সেক্ষেত্রে কোন প্রকার ভাঙন রোধে স্থানীয় মানুষেরা জোড়াতালি দেওয়ার মতো কাজ করে। তিনি আরো বলেন, পশ্চিম ও পূর্ব দুর্গাবার্টি থেকে প্রায় ৩০টা পরিবার গৃহহীন হয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। পশ্চিম দুর্গাবাটী ও পূর্ব দুর্গাবাটি মিলে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার বিঘা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। গাবুরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙনে প্রায় ২০০০ বিঘা জমি নদী ভাঙনে চলে গেছে নাপিতখালী, লেবুবুনিয়া, ৩নং বড় গাবুরা, কালীবাড়ি থেকে প্রায় শতাধিক পরিবার অভিবাসন হয়েছে। এছাড়া নদী বেষ্টিত ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন মুন্সীগঞ্জ, কৈখালী, কাশিমাড়ী, পদ্মপুকুর থেকে ৫ থেকে ৬ হাজার বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পূর্বপুরুষ থেকে এই এলাকার কৃষি নির্ভর মানুষের জীবন জীবিকার প্রধান উৎস ছিল।
দক্ষিণ অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সেচের পানি বিশেষ করে কৃষি কাজের জন্য মিষ্টি পানির অভাব এবং ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষের কারণে কৃষি জমির সংকট দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় কৃষি জমির সংকট নিরাশনের জন্য উপকূলবাসির দাবী ও করণীয়মূলক কাজ করার গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রথমত কৃষি জমিতে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ বন্ধ করে চিংড়ি চাষের জন্য নিধারিত জোন সৃষ্টি করতে হবে। এলাকায় জলাভুমি-খালগুলি দখল মুক্ত করে মিষ্টি পানির সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃষি কাজে যুক্ত করা।
সময় উপযোগী উচ্চ ফলনশীল লবণ সহ্য করতে পারে এমন ধান, গম, আলু, তরমুজসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করা। স্থায়িত্বশীল বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা। কৃষি আইনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা। পানি নিষ্কাশনের ও সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি জমির সংকট নিরাশন করা। কৃষি জমিতে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন বন্ধ করা। কৃষি জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
উপকূলের এই সকল সংকট নিরাশনের মাধ্যমে ফিরে পেতে পারে কৃষি পরিবেশ প্রতিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্রময় প্রকৃতি।
৭ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
৭ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে
৭ ঘন্টা ৩৩ মিনিট আগে
৭ ঘন্টা ৫০ মিনিট আগে
৮ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
৮ ঘন্টা ২৭ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ৫ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ৮ মিনিট আগে