◾মো. আব্দুস সাত্তার || আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান। সেই পদাধিকার বলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মিলে প্রত্যেকটি বিভাগে সাত কলেজের জন্য যে ১৩- সদস্য কমিটি আছে তার আমি কনভেনার। সেই সূত্রে, সাত কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান অনার্স ও মাস্টার্স শিক্ষার মান উন্নয়ন কিভাবে করা যায় সেই বিষয়ে ১৩-সদস্য কমিটিতে অনেক আলোচনা করেছি।
প্রথমেই যে বিষয়টি আলোচনায় আনি -তা হল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট কোচিং দেবে তা'রা পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারবে না। সাত কলেজের প্রত্যেকটি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে এ ব্যাপারে চিঠি প্রদান করি। তার অনুলিপি অধ্যক্ষদেরকে ও প্রদান করা হয়। তখন একটি বিষয় জানতে পেরেছিলাম যে, কোন কোন শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তাদের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করত ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করত।যদিও দু'একজন শিক্ষক এর পরিপ্রেক্ষিতে হয়তোবা সাড়া দিয়েছিল -পক্ষান্তরে কেউ কেউ বিষয়টি আমলেই নেয়নি।
অতঃপর ১৩-সদস্য কমিটির সভায় কলেজের প্রত্যেকটি পদার্থবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্ট থেকে কিছু শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভিন্ন কোর্স চলাকালীন সময়ে যোগদান করে বিষয় এক্সপার্ট হিসেবে নিজেকে তৈরি করার প্রস্তাব করি। সেই সময়কার বিভাগীয় প্রধানদের থেকে বলা হয় -কলেজের অফিসিয়াল কাজে শিক্ষকরা এতটাই ব্যস্ত থাকেন যার ফলে তা' সম্ভব নয়। অতএব উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়।যদিও ছাত্রদের পড়ানোই শিক্ষকদের মুখ্য দায়িত্ব।
অতঃপর আমার নেতৃত্বে ১৩-সদস্য কমিটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে কয়েকজন সদস্য নিয়ে (সম্ভবত ৫ /৬ সদস্য বিশিষ্ট) একটি কমিটি গঠন করা হয় -যে কমিটি সাত কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মতামত জানার চেষ্টা করবে -এর মাধ্যমে বিভাগ গুলোর দুর্বলতা চিহ্নিত করে -এর নিরসনের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তৈরি করা হবে। এ লক্ষ্যে উক্ত কমিটি একটি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীদের সাথে একটি ঘরোয়া আলোচনা করে । ছাত্রীরা বেশ উৎসাহ নিয়ে এ কাজে অংশগ্রহণ করে। এর মাধ্যমে বিভাগের কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জানতে পারলাম যে ঐ কলেজের কোন কোন শিক্ষক ছাত্রীদেরকে ডেকে ভয় ভীতি প্রদর্শন করে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন ব্যবহারিক পরীক্ষা নেয়ার জন্য ঐ কলেজে গিয়েছে তখন কোন কোন শিক্ষক আমার বিষয়ে অভিযোগ করেছে "তিনি কেন আমাদের ছাত্রীদের নিয়ে ভাবছেন -উনি ওনার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ভাবুন "।ছাত্র-ছাত্রী ও কলেজ শিক্ষকদের সম্পর্কের অবনতির কথা চিন্তা করে -এ উদ্যোগটি বন্ধ করে দেই।
অতঃপর ব্যবহারিক ক্লাস গুলির উন্নয়নের জন্য ১৩-সদস্যের কমিটির সভায় প্রস্তাব করি -ল্যাবের যন্ত্রপাতি সমস্যার বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রয়োজনে আমাদের বিভাগ থেকে সাহায্য করা হবে। আমাদের বিভাগের টেকনিশিয়ান দিয়ে তা মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে। ইতিমধ্যে একজন শিক্ষক বললেন -তিনি তার ল্যাবের যন্ত্র নিয়ে অবশ্যি আসবেন।সে আসা আর হয়নি। বিষয়টি অনেকবার আলোচনা করার পর -একদিন তিনি আসলেন। কিন্তু নষ্ট যন্ত্রপাতি আনা হয়নি।বুঝলাম উদ্যোগটি আমারই নিতে হবে। আমাদের বিভাগের একজন টেকনিশিয়ানকে ঐ কলেজের ল্যাবে পাঠাই।ফোনে জিজ্ঞেস করলাম -খবর কি? ল্যাব টেকনিশিয়ান জানালো -ল্যাবে চারটি নষ্ট oscilloscope আছে। দুটি মেরামত করা হয়েছে -বাকি দুটি ব্যবহার না করতে করতে এমনভাবে নষ্ট হয়েছে যে মেরামত করা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে আর কেউ তাদের নষ্ট যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেনি। এ উদ্যোগটিও ব্যর্থ হল ।
সেই সময়ে আমি বিজ্ঞান জাদুঘরের পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য -সেই সুবাদে কোন এক বোর্ড সভা শেষে বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে সাত কলেজে ল্যাবের দুরবস্থা নিয়ে আলোচনা করি। সচিব বললেন -কলেজ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাওয়া গেলে এর সমাধান কোন ব্যাপারই নয়। বিষয়টি ১৩-সদস্য কমিটিতে আলোচনা করি। অনেকদিন পর্যন্ত এর কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে -আমি আমার ছাত্রী কোন এক কলেজের বিভাগীয় প্রধানকে কারণটি জিজ্ঞেস করি। তার উত্তর হল "আমরা কলেজের অধ্যক্ষের মতামত ছাড়া এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারি না। কলেজের অধ্যক্ষগণ ও এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে রাজি নয়"। উদ্যোগটি ব্যর্থ হল। অথচ ২/১টি কলেজ ছাড়া বাকি কলেজগুলোতে ব্যবহারিক ক্লাস একেবারেই হয় না।
আসল কথা হল ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য -তাদের করুণ দুরবস্থা নিরসনের জন্য কলেজের শিক্ষকদেরই আগে এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিজেদের ছেলে মেয়ের মতো মনে করতে হবে -তা না হলে এর সমস্যার সমাধান হবে না। প্রত্যেক বছর সাত কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে আনুমানিক ১৩/১৪ শ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। চার বছরের শিক্ষাজীবন শেষে -আনুমানিক ৩০/৪০ জন ছাত্র-ছাত্রী অনার্স ডিগ্রী পায়। এতগুলো ছেলে মেয়ের জীবনের এই করুন পরিণতির দায় কি কারোরই নেই? এমন উদাহরণও আছে ৭০/৮০ জন ছাত্রী ভর্তির পর একজন মাত্র অনার্স ডিগ্রী পেয়েছে। এ সমস্যাটিকে কেউ-ই আমলে নিচ্ছে না।
একটি সময় ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় ২০-টি কলেজ ছিল। সেখানে পাস কোর্স ও অনার্স দুটিই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগ আলাদাভাবে এসব দেখভাল করত। মাস্টার্স কোর্সটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে,জাতীয় গবেষণাগার, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কিছু নামকরা ব্যক্তি ছিলেন এবং এখনো আছে -যারা ঐ সব কলেজ থেকে বি এস সি পাস ও অনার্স ডিগ্রী লাভ করে তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
আবেগ নয় -জেদ নয় -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুক্তির বিষয় নয় -সাত কলেজের হতভাগা ছাত্রছাত্রীদের সমস্যাটির সমাধান কোন পথে সম্ভব -তা আন্তরিকতার সাথে ভাবতে হবে। ওদের সমস্যাকে নিজের সন্তানের সমস্যা হিসেবে ভাবুন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হবে -ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, ডীন ইত্যাদি হবেন। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের কি হবে আগেই ভেবে নিন। সবকিছুই যেন ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে হয়। • ( ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
……………
» লেখক : মো. আব্দুস সাত্তার
সাবেক চেয়ারম্যান,
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৮ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ০ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ২ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ৪ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ৬ মিনিট আগে
১২ ঘন্টা ২৩ মিনিট আগে
১৫ ঘন্টা ৪৩ মিনিট আগে