◾ সুখবর ও ইতিবাচক ডেস্ক
প্রতি মৌসুমে প্রায় দুই শত মণ মধু উৎপাদন করছেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামের আবুল কালাম সরদার (৫৮)। বর্তমানে তার উৎপাদিত মধু দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। এতে বছরে তার মুনাফা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ টাকা। সফলতার জন্য পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও।
মধু চাষে আবুল কালাম একাই লাভবান হচ্ছেন না, অন্যদেরও স্বাবলম্বী করতে গড়ে তুলেছেন ‘খুলনা মৌ-চাষী কল্যাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে সংগঠনও। এ সংগঠনে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৩৫ সদস্যের প্রত্যেকে করছেন মৌচাষ। আবুল কালাম তাদের মৌমাছি পালন, মধু উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সকল কৌশল হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দামোদর গ্রামের মৃতঃ আকাম সরদারের ছেলে আবুল কালাম সরদার বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প) এর আওতায় মৌচাষ (মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদন) বিষয়ক দুই মাসের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে মৌমাছিসহ একটি বাক্স দেওয়া হয়। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে বাবার ছোট্ট মুদি দোকানে তাকে সময় দিতে হয়। ফলে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে ২০০২ সালে বিসিক থেকে ২৮ হাজার টাকা দিয়ে ১১টি বাক্স অর্থাৎ ৩৩টি ফ্রেম মৌমাছিসহ কেনেন। প্রথম বছর মধু মৌসুমে ৬০ হাজার টাকা লাভ হয়। পরের বছর আরও ৩৫ বাক্স তৈরি করে মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদনে নেমে পড়েন। সেবারও লাভের পরিমাণ ছিল লক্ষাধিক টাকা। এভাবে পর্যায়ক্রমে বর্তমানে এসে ২৫০ বাক্সে ফ্রেম সংখ্যা দাড়িয়েছে আড়াই হাজারে। বার্ষিক মধু উৎপাদনের পরিমান দাড়িয়েছে দুই শত মণ।
মৌ চাষি আবুল কালাম সরদার জানান, মধু মৌসুম শুরু ডিসেম্বর মাসে, চলে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। বিভিন্ন ফুলের মৌসুম বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে। সরিষা ফুলের মৌসুম ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। এটি পাওয়া যায় সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, জামালপুর ও কুড়িগ্রামে। ধনিয়া ফুলের মধু সংগ্রহ করতে হয় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে, আর কালোজিরা ফুলের মধু ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে শরিয়তপুর, ফরিদপুর, ও রাজবাড়ী থেকে। লিচু ফুল মার্চ মাসে ঢাকা, গাজীপুর, পাবনা, নাটোর, দিনাজপুর ও যশোর থেকে। মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের শ্যামনগর, বুড়িগোয়ালিনি থেকে গোলাখালি পর্যন্ত খোলপেটুয়া নদীর এপারে মৌমাছির বাক্স রেখে অবস্থান করতে হয়। সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যায়ক্রমে খলিসা ফুল, গরান, কেওড়া ও বাইন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ হয়ে থাকে। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সাতক্ষীরা, কলারোয়া এলাকায় বরই ফুল থেকে কিছু মধু সংগৃহীত হয়। বছরের বাকি ৬ মাস মৌমাছিকে তোলা খাবার হিসাবে চিনি ও বিগত বছরের মধু খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এ সময় নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লা এলাকায় বিভিন্ন ধরণের সবজি ও ধনিয়া ফুল থেকে কিছু মধু সংগ্রহ করা যায়। সেটিও মৌমাছির খাদ্য।
আবুল কালাম সরদার আরও জানান, মৌমাছির বড় শত্রু ফিঙে রাজা, সুইচোরা পাখি ও ভিমরুল। এরা মৌমাছি ধরে খায়। সেক্ষেত্রে গুলতি দিয়ে ফিঙে দমন, জাল পেতে সুইচোরা এবং বাসা পুড়িয়ে দিয়ে ভিমরুল দমন করতে হয়। ৫ ফ্রেমের ১ কলোনিতে ১টা রাণি মাছিসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুরুষ ও শ্রমিক মৌমাছি থাকে। এর দাম ২৫০০ টাকা এবং ফ্রেমের মূল্য ১৫০০ টাকা। বাক্স প্রতি এক মধু মৌসুমে ১ থেকে দেড় মণ মধু উৎপাদিত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি মাছি ১ হাজার ফুল পরিভ্রমণ করে এক ফোটা মধু তৈরি করে। আবার ফুল থেকে সংগৃহীত মধুর মাত্র ২০ ভাগ উৎপাদিত হয়। চাষের মাছির গড় আয়ু ৪২ দিন। জন্মের প্রথম ২১ দিন বাক্সে থেকে কর্মক্ষম হয়। জীবনের বাকি ২১ দিনে চা চামচ মধু সংগ্রহ করে।
সফল মৌচাষি আবুল কালাম জানান, বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ফুল থেকে সংগ্রহকৃত মধুর রং, স্বাদে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে দামও ভিন্ন। ‘সলিড মধু’ নামে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সরিষা ফুলের মধুর খুচরা মুল্য কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা, লিচু ফুলের ৩৫০ টাকা, সুন্দরবনের মধু ৫০০ টাকা, ধনিয়া ফুলের ৩০০ টাকা, কালো জিরা ১ হাজার টাকা, বরই ফুল ৩০০ টাকা। গত মৌসুমে তার উৎপাদিত দুই শত মণ মধুর গড় ২৫০ টাকা কেজি হিসাবে পাইকারি মূল্য ছিল প্রায় ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৬ জন কর্মচারীর বেতন, ভরণপোষন বাবদ ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা, পরিবহণ বাবদ খরচ ২ লাখ টাকা এবং খাবারসহ মৌমাছি পালন ৩ লাখ টাকা, স্থান ম্যানেজে ১ লাখ টাকা ও আয়কর প্রদানসহ খরচ পড়ে ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। ফলে তার নীট মুনাফা ছিল ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তার উৎপাদিত মধু দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এখন দেশের বাইরে সৌদি, কাতার, কুয়েত এ রফতানি হচ্ছে।
মৌচাষি আবুল কালাম জানান, এ অঞ্চলের মধু মানসম্মত ও দামে কম হওয়াতে চোরাইপথে ভারতে পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া দেশে আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও সুষ্ঠু বাজারজাতের ব্যবস্থা না থাকায় স্বল্পমূল্যে বিদেশে রফতানি করতে হয়।
মৌচাষি আবুল কালাম সরদার নিজে স্বাবলম্বী হয়ে অন্যদের স্বাবলম্বী করতে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ‘খুলনা মৌচাষি কল্যাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে রেজিস্টেশনকৃত সমিতি। নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ৩৫ সদস্যের প্রত্যেকের রয়েছে স্বল্প পরিসরে মৌচাষ। আবুল কালাম নিজে তাদের মৌমাছি পালন, মধু উৎপাদন ও বাজারজাত করণের সকল কলা কৌশল হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
২০১৯ সালের ১১ মার্চ রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় আকামু গিয়াস উদ্দিন মিল অডিটরিয়ামে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মীর নুরুল আলমের হাত থেকে জাতীয় মৌ মেলা-২০১৯ এ সফল মৌচাষি আবুল কালাম সরদার পুরস্কার লাভ করেন।
আবুল কালাম সরদারের ছেলে মো. হাসানুল বান্না বিএল কলেজের মাস্টার্স পাস করেন। তিনি মৌচাষে দক্ষতা অর্জন করায় বিসিক, যুব উন্নয়ন ও সমবায় অধিদপ্তরের প্রশিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
১৪ দিন ১১ ঘন্টা ১৬ মিনিট আগে
১৮ দিন ২ ঘন্টা ৭ মিনিট আগে
২৬ দিন ১৭ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে
২৭ দিন ৬ ঘন্টা ১৫ মিনিট আগে
২৭ দিন ৭ ঘন্টা ৮ মিনিট আগে
২৮ দিন ৩ ঘন্টা ৩১ মিনিট আগে
৩৮ দিন ২৩ ঘন্টা ১৮ মিনিট আগে
৩৯ দিন ২ ঘন্টা ২৩ মিনিট আগে