চাকুরীতে
যোগদান মানে জীবনকে সময়ের এক দুষ্টু চক্রে
আবদ্ধ করে ফেলা। বিশেষ করে প্রাইভেট চাকুরী। তখন আর সৃজনশীল ও
মুক্ত চিন্তা বা নিজের স্বাধীন
ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করা যায় না। চাকুরীর নির্ধারিত সময় ও নিজের আনুসাঙ্গিক
কাজে চলে যায় দিনের পুরোটা সময়। এভাবে শুধু ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানো আর দিন গণনা
করা। শৈশব কৈশরের মুক্ত দিনগুলো তখন শুধুই স্মৃতি হয়ে যায়। মুক্ত ডানার পালকগুলো ঝরে পড়ে আর সুদৃঢ় হয়
বন্ধিশালার এক নির্মম শৃংখল।
মাস শেষে টাকাটাই শান্তনা। জীবনকে করে দেয় সংক্ষিপ্ত এবং যান্ত্রিক। সাপ্তাহিক ৫২ দিন ও
অন্যান্য ছুটি মিলে সর্বোচ্চ ৮০ দিনে বছর
শেষ। বাড়তি কিছু ভাবনার সময়টুকুও পাওয়া যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে কর্ম ঘন্টা কমিয়ে ভালো ফল পাচ্ছে। কিন্তু
আমাদের দেশে আমরা সেটা ভাবতেও পারি না। life is short but art is long এই
কথার অর্থ চাকুরীজীবিদের কাছে সুস্পষ্ট। তার পরও আবেগকে বিসর্জন দিয়ে জীবন যুদ্ধে (battle of life) এগিয়ে
যেতে হয়।
এই
সংগ্রামী জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে অনেকে হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এই পর্যায়ে জীবনকে
স্বাভাবিকভাবে নিতে হলে নিজের যতটুকু সামর্থ আছে তা নিয়েই জীবন
সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। সমস্যাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু
নেই বরং সমস্যা আছে বলেই জীবনে জেতার সম্ভবনা আছে।
কর্ম
ও জীবন একই সাথে সুষ্ঠভাবে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কয়েকটি ট্রিপসঃ
১।
পারিবারিক জীবন
পারিবারিক
জীবন স্বচ্ছ ও সুন্দর রাখতে
চাইলে চাকুরী এবং চাকুরীতে নিজের অবস্থানটি পরিবারের কাছে সুস্পষ্ট করতে হবে। কাজের খাতিরে পরিবার থেকে দূরে থাকলেও তাদের প্রতি দায়িত্ববান হতে হবে। পরিবারের দায় দায়িত্বটা মূলত বয়সের ভিন্নতার উপর নির্ভর করে। পরিবারের সদস্য বিশেষ করে বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব সর্ব অবস্থায় নিতে হবে। স্ত্রী, সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব অত্যাবশ্যকীয়। তাদের চাহিদা পুরণ করা মৌলিক দায়িত্ব। ছোট খাট কিছু দায়িত্ব তাদের মধ্যেও ভাগ করে দিতে হবে। যেগুলো বেশী গুরুত্বপূর্ণ বা কঠিন সেগুলো
নিজের মধ্যে রাখাই ভাল। তাদেরকে সময় দিতে হবে। কাজের কারণে দূরে থাকলেও সর্ম্পকের দূরত্ব সৃষ্টি করা যাবে না। ভাইবোন এবং নিকট আত্মীয় যারা আছে তাদের সাথেও কাজের ফাঁকে এবং অবসরে যোগাযোগ রাখতে হবে। তাদেরকে সময় দিতে হবে। দেশ ও জাতির ইতিহাস
ও ঐতিহ্যের সাথে সন্তানদেরকে পরিচয় করে দিতে হবে। দেশাত্মবোধক কাজে উৎসাহ দিতে হবে। ধর্ম ও নীতি নৈতিকতার
শিক্ষা দিতে হবে।
২।
পড়াশুনা বা ক্যারিয়ার
চাকুরীজীবিদের
অনেকেরেই দেখা যায় ক্যারিয়ার বা পড়াশুনার প্রতি
অমনোযোগী হয়ে পড়ে। যা
মোটেও সমীচিন নয়। পড়াশুনা ও ক্যারিয়ার গঠনের
জন্য অবশ্যই সময় বের করে নিতে হবে। বাসায় কিংবা অফিসে কাজের ফাঁকে এবং অবসর সময়ে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে নোট বুক, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহার করা যেতে পারে। অন লাইনে সহপাঠিদের
সাথে আড্ডার ফাঁকে ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ক্যারিয়ার বিষয়ক অনেক কোর্স আছে সেগুলো করা যেতে পারে। সময় পেলে টিউশনি করা যেতে পারে। পত্রিকা, সমকালিন খবরাখবর, গল্পের বই অথবা সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন মাধ্যমের সাথে সংযুক্ত করা যেতে পারে।
৩।
বিকল্প আয়ের উৎস
চাকুরীর
পাশাপাশি অন্য আয়ের উৎস সন্ধান করতে হবে। একটি মাত্র আয়ের উৎস দিয়ে সঠিকভাবে টিকে থাকা কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়বে। কারন সংসার বড় হওয়ার সাথে
সাথে খরচের খাত বেড়ে যায় কিন্তু চাকুরীতে সেভাবে বেতন বাড়ে না; তাই বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করতে হবে। যেমন, অন লাইনে ফ্রিল্যান্সিং,
স্টক এক্সচেঞ্জ, ল্যান্ড এন্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যবসা, পার্টনারশিপ ব্যবসা, খন্ডকালিন ব্যবসা। এভাবে ছোটখাট টাকা উপার্জনের বৈধ পাইপলাইন তৈরী করতে হবে।
৪।
আত্মীয় ও বন্ধু বান্ধব
কর্মক্ষেত্রে
প্রবেশের পর সময়ের অভাবে
পুরনো বন্ধু এবং আত্মীয়ের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখাটাও কঠিন হয়ে পড়ে। তবে তাদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ রাখা যায়। ঈদ পূজা কিংবা
অন্যান্য সাধারন ছুটির দিনগুলোতে তাদের বাসায় বেড়াতে যাওয়া যায় কিংবা তাদেরকে নিজের বাসায় দাওয়াত দেওয়া যায়। প্রতিবেশীদের খোঁজ খবর নিয়ে বিপদে আপদে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। স্কুল কলেজ ও ভার্সিটি সহপাঠিদের
সাথে যোগাযোগ রাখা জরুরী। দেখা হলে চা কফি আড্ডা
দেওয়া যেতে পারে। সর্বোপরী সবার সাথে ভাল ব্যবহার ও হাসি মুখে
কথা বলা জরুরী।
৫।
সামাজিক দায়বদ্ধতা
মানুষ
সামাজিক জীব। যারা যে পরিবেশে বেড়ে
উঠে, পড়াশুনা করে তাদের প্রত্যেকের একটি সামাজিক নেটওয়ার্ক থাকে। কর্মক্ষেত্রে এসে সেগুলো থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। সুযোগ পেলেই যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। অনেকে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত থাকে যেমন উন্নয়ন মূলক, রক্ত দাতা সংগঠন, রোটারী ক্লাব, পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন। অনেকে আবার মানব সেবা মূলক, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ইত্যাদি কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকে সময় ও সুযোগ করে
তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা যেতে পারে।
৬।
ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ
যারা
ধার্মিক তারা কাজের ফাঁকেই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের কাজগুলো সেরে নেয়। তাছাড়া সপ্তাহান্তে অথবা মাসিক ধর্মীয় স্থানগুলোতে ভ্রমন করলে মন ফ্রেশ হয়ে
যাবে। মুসলিমগণ যাদের সামর্থ আছে তারা হজ্জ্ব বা ওমরাহ্র উদ্দেশ্যে
ভ্রমন করতে পারেন। অন্যান্য ধর্মের যারা আছেন তারাও বিভিন্ন ফ্যাস্টিভ্যালে নিজের ধর্মীয় কাজটি সেরে নিতে পারেন।
৭।
রাজনৈতিক কর্মকান্ড
ছাত্র
বয়সে যারা রাজনীতির সাথে জড়িত থাকেন বা ফ্যামিলিগতভাবে রাজনীতির
সাথে জড়িত তারা অন লাইনে সক্রিয়
থাকতে পারেন। জাতীয় দিবসগুলো বা শিক্ষামূলক যেকোন
অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করলে পুরানো স্বাদ কিছুটা পাওয়া যেতে পারে। ঈদ বা পূজার
ছুটিতে ঈদ পুণর্মিলনী বা
বর্ধিত সভায় অংশ গ্রহণ করা যেতে পারে। নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা অথবা শুভেচ্ছা বিনিময় করা যেতে পারে। তবে কর্মক্ষেত্রে এটা প্রকাশ না পাওয়াই উত্তম।
৮।
বিনোদন ও খেলাধূলা
কাজের
প্রচন্ড চাপের মধ্যেও মনকে প্রশান্ত ও চনমনে রাখতে
ছুটির দিনগুলোতে পরিবার পরিজনদের নিয়ে যেকোন বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করা যেতে পারে। সন্তানদের নিয়ে শিক্ষামূলক সিনেমা, থিয়েটার, পার্ক ও ঐতিহাসিক স্থান
ভ্রমণ করা যেতে পারে। টিভি মোবাইলে সুস্থ্য বিনোদন উপভোগ করা যেতে পারে। জাতীয় দিবসগুলোতে যেমন, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি দিনে ঐতিহাসিক স্থান গুলোতে ঘুরে আসা যেতে পারে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শপিং, সাধ্যেও মধ্যে ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করা যেতে পারে। সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখা, জাতীয় জাদুঘর, চিড়িয়াখানা ঘুরে আসা যেতে পারে। সময় করে দেশের ভিতরে অথবা দেশের বাহিরেও ভ্রমন করা যেতে পারে।
যাদের
খেলাধূলার অভ্যাস রয়েছে তারা বাচ্চাদের সাথেই খেলায় নেমে পরতে পারেন। পার্কে হাটাহাটি দৌড়, ফুটবল, ব্যাটমিন্টন, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলাতেও মনেনিবেশ করতে পারেন। এতে ছোট খাট দুশ্চিন্তা ও জড়া জীর্ণতা
কাটিয়ে উঠতে পারেন। মনও ফ্রেশ হয়ে যাবে।
৯।
ব্যক্তিগত জীবন
মানুষের
একটি কল্পনার জগৎ থাকে। সে জগতের চারপাশে
যা কিছু দেখে শুনে অনুভব করে সেটা নিয়েই সে ভাবে। তবে
নিজের চেয়ে অন্যকে নিয়েই বেশী ভাবতে পছন্দ করে; হয়তো সেটা প্রিয়জন অথবা দুঃশমন। কর্ম, উপার্জন, খরচ এবং সঞ্চয় সেটাও শুধু নিজের জন্য নয়। পরিবারের লোকদের ভরনপোষন, তাদের ভবিষ্যত চিন্তা, সমাজ ও দেশের জন্য
চিন্তা করে। শত ব্যস্ততা ও
ভাবনার মাঝেও নিজের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে নিজের খাওয়া দাওয়া, ঘুম, স্বাভাবিক বিশ্রাম, স্বাস্থ্য সচেতনতা, মানসিক স্বাস্থ্য, মেজাজের ভারসাম্য সর্বোপরী শারীরিক ও মানসিক সুস্থ্যতা
প্রয়োজন। এই জন্য দিনের
শুরুতে একটু হাটাহাটি ব্যায়াম, আয়েশ করে চা কফি খাওয়া,
ঘুমানোর আগে মেডিটেশন বা ব্যয়াম করা।
যারা ধর্ম পালনে অভ্যস্ত তারা নিজনিজ ধর্ম পালন করা। অনেকের অনেক ব্যক্তিগত গুণাবলী থাকে যেমন ভাল আর্ট করতে জানে, কেউ গান গাইতে জানে, কেউ খেলাধুলায় ভালো, কারো লেখার হাত ভাল। শত ব্যস্ততার ফাঁকে
হলেও এগুলো চালিয়ে যেতে হবে। এতে মানুষের ব্যক্তিত্ব বাড়ে।
সর্বোপরী মানুষের জীবনটা অনেক বৈচিত্রপূর্ণ হয় এবং স্তরে স্তরে ঘটে নানা পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে ঘটে চাহিদারও পরিবর্তন। মানুষের পৃথিবীটা মূলত গড়ে উঠে এসব উপকরণের মধ্য দিয়েই। শিশুকাল থেকে বার্ধক্য সব পর্যায়ে এই উপকরণগুলো মানুষের জীবনকে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। তবে একেক পর্যায়ে একেকটির আধিক্য দেখা যায়। জীবনের প্রয়োজনে প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
লেখক: মো. সুমন মিয়া, `গহীনে শব্দ' কাব্যগ্রন্থ, সম্পাদক- চান্দিনা দর্পণ
৭ দিন ১৮ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে
৮ দিন ৮ ঘন্টা ২৯ মিনিট আগে
১০ দিন ৭ ঘন্টা ৩২ মিনিট আগে
১৩ দিন ১০ ঘন্টা ৪০ মিনিট আগে
১৮ দিন ২১ ঘন্টা ৪ মিনিট আগে
২৩ দিন ৬ ঘন্টা ৪৯ মিনিট আগে
২৩ দিন ৭ ঘন্টা ১৮ মিনিট আগে
২৩ দিন ২১ ঘন্টা ৪ মিনিট আগে