সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা একচ্ছত্র বিশ্বশক্তি হিসেবে যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ পায়। এই সময়ে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, যুগোস্লাভিয়া সহ অন্তত সাতটি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। উদ্দেশ্য ছিল "রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা" প্রতিষ্ঠা এবং "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ"—কিন্তু ফলাফল হলো একের পর এক ব্যর্থতা, বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষয়, লাখো প্রাণহানি এবং রাজনৈতিক পতন। একটি যুদ্ধও আমেরিকার পক্ষে চূড়ান্তভাবে জেতা সম্ভব হয়নি।
আফগানিস্তানে ২০০১ সালে হামলা চালিয়ে শুরু হয় ২০ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধ। সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের নামে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তালেবানের হাতেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে ২০২১ সালে আমেরিকাকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছে। এই যুদ্ধের মোট খরচ ছিল ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার, নিহত হয় প্রায় ২,৪০০ মার্কিন সেনা এবং বহু আফগান বেসামরিক নাগরিক।
২০০৩ সালে ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অভিযোগে হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনের সরকার উৎখাত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেই অভিযোগের ভিত্তি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। যুদ্ধের খরচ হয় ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার, এবং দেশটি আজো গৃহযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও ইরানি প্রভাবের মধ্যে বিপর্যস্ত।
২০১১ সালে লিবিয়ায় ন্যাটোর নেতৃত্বে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বোমাবর্ষণ ও তার পতনের মাধ্যমে দেশটিকে একরকম রাষ্ট্রহীন করে তোলা হয়। আজ পর্যন্ত সেখানে কোনো কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হয়নি। দেশটি মিলিশিয়া ও বিদেশি স্বার্থের সংঘাতে দ্বিখণ্ডিত।
সিরিয়ায় ২০১৪ সালে ুআসাদ মাস্ট গো” স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু এক দশক পার হয়ে যাওয়ার পরও বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় ছিল, যতদিন না ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের ৮ তারিখে বিদ্রোহী জোট দামাস্কাস দখল করে এবং আসাদকে অপসারিত করে। আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যায় এবং ৫০ বছরের বাথ পার্টি শাসনের অবসান ঘটে। বর্তমানে দেশটি হায়াত তাহরির আল-শাম (ঐঞঝ) নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। এই সরকার নানা প্রতীকী প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে শুরুর দিকে আশার জন্ম দিলেও, ঐঞঝ এর আধিপত্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে তা এখন নতুন ধরনের স্বৈরশাসনের শঙ্কা তৈরি করেছে। দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, মুদ্রার মূল্য ৯৯ শতাংশ হারিয়েছে, এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থীদের জীবন এখনও বিপন্ন।
এই প্রতিটি যুদ্ধেই আমেরিকা আধুনিক অস্ত্র, ড্রোন, স্যাটেলাইট এবং বিপুল প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, কিন্তু কোনো যুদ্ধেই তার রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। কারণ যুদ্ধগুলো ছিল অ্যাসিমেট্রিক—এক পক্ষে আধুনিক প্রযুক্তি, আরেক পক্ষে স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধ, গেরিলা কৌশল, সামাজিক ক্ষোভ এবং ধর্মীয়-জাতিগত পরিচয়ের ওপর নির্মিত দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত। আধিপত্যের প্রযুক্তি দিয়ে আদর্শ ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ দমন করা যায় না।
এই প্রেক্ষাপটে ইরান এক অনন্য বাস্তবতা। সামরিক বাজেট মাত্র ২০ বিলিয়ন ডলার হলেও, ইরান গড়ে তুলেছে এক ধরনের আদর্শভিত্তিক প্রতিরোধ কাঠামো—হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাস, হাশদ আল শাবি—এরা সবাই ইরানের সরাসরি মিত্র নয়, কিন্তু পরোক্ষভাবে তার প্রতিরোধব্যবস্থার অংশ। এপ্রিল ২০২৪ সালে ইরান ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের ওপর সরাসরি ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। যদিও বেশিরভাগই প্রতিহত হয়, তারপরও এটি ছিল এক স্পষ্ট বার্তা—ইরান যদিও মরে, মরার আগেই সে জবাব দেবে, আর সেই জবাব হবে প্রতিপক্ষের জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এটিই ইরানের ুগধৎঃুৎফড়স উড়পঃৎরহব”—যেখানে মৃত্যু মানে শেষ নয়, বরং প্রতিপক্ষকে আঘাত করার এক কৌশল।
২০০১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আমেরিকার যুদ্ধ-সংক্রান্ত মোট ব্যয় প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে শুধুই সরাসরি সামরিক ব্যয় ৫.৮ ট্রিলিয়ন, বাকি অংশ এসেছে যুদ্ধপরবর্তী বরাদ্দ, প্রবীণদের চিকিৎসা এবং সুদ পরিশোধে। অথচ এত বিপুল ব্যয়েও একটি যুদ্ধেও জয় নিশ্চিত হয়নি। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া—সবখানেই আজ আমেরিকার প্রভাব কমছে, রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, আর যারা উঠে এসেছে—তারা অধিকাংশই আমেরিকার প্রতিপক্ষ।
এই বিশ্লেষণের প্রয়োজন একটাই—কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব সরাসরি যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে, এবং সেই যুদ্ধে আমেরিকা জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দিনদিন প্রবল হয়ে উঠছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যে যুদ্ধ-অনুমোদনের কথা বলেছেন, এবং রিপাবলিকান প্রশাসনের অনেকেই এটিকে ুনিষ্ঠুর প্রতিশোধের সময়” বলে উস্কানি দিচ্ছেন। কিন্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—এটি হবে আরেকটি আফগানিস্তান, আরেকটি ইরাক। ইরানকে সামরিকভাবে ধ্বংস করা সম্ভব হলেও, রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করা সম্ভব নয়। কারণ ইরান শুধু একটি রাষ্ট্র নয়, বরং একটি কৌশলগত আদর্শ—যার ছায়া বিস্তৃত রয়েছে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও গাজার মতো অঞ্চলজুড়ে।
ইরানের ক্ষেত্রেও সম্ভবত একই ঘটনা ঘটবে—তবে আরও শোচনীয়ভাবে। ইরান মরবে ঠিকই, কিন্তু তার সীমিত সামর্থ্য দিয়েই আমেরিকা বা ইসরায়েলকে গুরুতর আহত করে মরবে। কারণ যুদ্ধের শুরুতে হয়তো মার্কিন বিমান বাহিনী বা ইসরায়েলি প্রযুক্তি ইরানের পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবে না। বরং শুরু হবে এমন এক প্রতিশোধের চক্র, যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থির করে তুলবে। আর এই ধরনের স্ট্র্যাটেজির বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদী শক্তির জয়ের ইতিহাস এখন পর্যন্ত শুন্য।
লেখক
মুহা. মহিব্বুল্লাহ
৩ ঘন্টা ৩৪ মিনিট আগে
১৩ দিন ২ ঘন্টা ১৬ মিনিট আগে
২২ দিন ৮ ঘন্টা ৪০ মিনিট আগে
৩৩ দিন ২ ঘন্টা ২৮ মিনিট আগে
৪২ দিন ১ ঘন্টা ৮ মিনিট আগে
৬৪ দিন ৯ ঘন্টা ৪৪ মিনিট আগে
৭০ দিন ৩ ঘন্টা ৫৯ মিনিট আগে
৭১ দিন ৩ ঘন্টা ৫৯ মিনিট আগে