রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও তার শিষ্য এরিস্টটলকে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ দুজন চিন্তাবিদ রাষ্ট্রের ধারণা, লক্ষ্য, কাঠামো, নেতৃত্ব এবং ন্যায়বিচার সংক্রান্ত যে দর্শন উপস্থাপন করেছেন, তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। প্লেটো যেখানে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছেন, সেখানে এরিস্টটল রাষ্ট্রকে একটি বাস্তব সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাদের রাষ্ট্রচিন্তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ আমাদেরকে রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘আদর্শ রাষ্ট্র’। তার বই "The Republic" বা "রাষ্ট্র" গ্রন্থে তিনি এমন এক রাষ্ট্রের চিত্র আঁকেন যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং প্রত্যেক মানুষ তার উপযুক্ত দায়িত্ব পালন করবে। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্র তখনই ন্যায়পরায়ণ হবে, যখন রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশ তার নিজ নিজ কাজ করবে—নেতৃত্ব দেবে জ্ঞানীরা, যুদ্ধ করবে সাহসীরা এবং উৎপাদনে থাকবে সাধারণ জনগণ। প্লেটো রাষ্ট্রকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেন:
জ্ঞানী (Philosopher-Kings) – তারা শাসক হবেন; কারণ তাদের আত্মা যুক্তিবাদী।
রক্ষক (Auxiliaries) – তারা সৈনিক হবেন; আত্মায় সাহসী।
উৎপাদক (Producers) – কৃষক, কারিগর, ব্যবসায়ী ইত্যাদি; আত্মায় আকাঙ্ক্ষাবাদী।
এই শ্রেণিবিন্যাস প্লেটোর “ত্রিভাগীয় আত্মাতত্ত্ব”-এর উপর ভিত্তি করে, যেখানে যুক্তি, সাহস ও আকাঙ্ক্ষা আত্মার তিনটি উপাদান।প্লেটোর চিন্তায় নারীদের শিক্ষা ও শাসনে অংশগ্রহণের অধিকার ছিল। এটি ছিল তৎকালীন সমাজের তুলনায় বিপ্লবাত্মক। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি নারী-পুরুষ একই প্রশিক্ষণ পায়, তবে নারীও শাসনে দক্ষ হতে পারে।
প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা একটি আদর্শ রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ দেখায়, যেখানে জ্ঞানী শাসক, ন্যায়ভিত্তিক শ্রেণি ও নৈতিক মূল্যবোধে গঠিত সমাজ বিদ্যমান থাকবে। বাস্তব দুনিয়ার সীমাবদ্ধতা তিনি কিছুটা উপেক্ষা করেছেন।
এরিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা এরিস্টটল প্লেটোর শিষ্য হলেও তিনি ছিলেন আরও বাস্তববাদী। তার গ্রন্থ "Politics"-এ তিনি রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক ও অপরিহার্য সামাজিক সংগঠন হিসেবে দেখিয়েছেন, যার উদ্দেশ্য হলো “সকল কল্যাণ সাধন” (the good life)। তিনি বলেছেন: “মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণী” (Man is by nature a political animal)। অর্থাৎ, মানুষের প্রকৃতিগত চাহিদা থেকেই রাষ্ট্রের জন্ম।
এরিস্টটলের মতে, পরিবার থেকে গ্রাম, এবং গ্রাম থেকে নগররাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। আর নগররাষ্ট্রই হলো পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষা নয়, বরং নৈতিক উন্নয়ন ও কল্যাণ অর্জন।
এরিস্টটল তিন ধরনের শাসনব্যবস্থা চিহ্নিত করেন:
একজন শাসক → রাজতন্ত্র (Monarchy) → বিকৃত হলে → স্বৈরতন্ত্র (Tyranny)
অল্প কয়েকজন শাসক → অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) → বিকৃত হলে → গণতন্ত্র (Oligarchy)
সবাই মিলে শাসন → গণতন্ত্র (Polity) → বিকৃত হলে → জনতন্ত্র (Democracy)
তবে তার গণতন্ত্র বর্তমান সময়ের "গণতন্ত্র" নয়, বরং "জনতার শাসন" যেখানে দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণি ক্ষমতায় আসত। এরিস্টটল মনে করতেন, সমাজে স্থিতি ও ভারসাম্য বজায় রাখতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রাধান্য থাকা জরুরি। কারণ তারা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে। এরিস্টটলের একটি বিতর্কিত মত হলো—তিনি দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বলে বিবেচনা করেন। নারীর ক্ষেত্রেও তিনি পুরুষের তুলনায় অধস্তন অবস্থানে রাখেন, যা সমকালীন মানবাধিকার ধারণার পরিপন্থী। প্লেটো যে “আদর্শ রাষ্ট্র”-এর কথা বলেন, তা সমাজে বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। এর বিপরীতে, এরিস্টটল বাস্তব সমাজ ও তার সীমাবদ্ধতার আলোকে একটি কর্মযোগ্য রাষ্ট্রচিন্তা উপস্থাপন করেন। প্লেটো ও এরিস্টটল উভয়ের রাষ্ট্রচিন্তা আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
রিপাবলিকানিজম, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী চিন্তায় প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ছায়া দেখা যায়। গণতন্ত্র, সাংবিধানিক শাসন ও মধ্যবিত্তের গুরুত্বের দিকটি এরিস্টটলের চিন্তা থেকে অনুপ্রাণিত। প্লেটোর চিন্তায় বাস্তবতার অভাব রয়েছে, অনেকটাই কল্পনানির্ভর। এরিস্টটল দাসপ্রথাকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে যে মত দিয়েছেন, তা মানবাধিকারের পরিপন্থী। উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী-পুরুষ সমতা স্পষ্ট নয়।
প্রাসঙ্গিকতা: বর্তমান সময়ে ভালো শাসক নির্বাচন, সুশাসনের কাঠামো, শিক্ষার গুরুত্ব, শ্রেণি বৈষম্য ইত্যাদি আলোচনায় তাদের চিন্তা এখনও প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্র পরিচালনায় নৈতিকতা ও কল্যাণ—এ দুটো বিষয়েই এদের চিন্তাধারা যুগোপযোগী দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
প্লেটো ও এরিস্টটল ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃত পথপ্রদর্শক। প্লেটো রাষ্ট্রকে দেখেছিলেন নৈতিক আদর্শের বাস্তবায়ন হিসেবে, আর এরিস্টটল দেখেছিলেন এক বাস্তব সামাজিক সংগঠন হিসেবে। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পরস্পর থেকে ভিন্ন হলেও রাষ্ট্র, সমাজ ও ন্যায় নিয়ে গভীর আলোচনার দরজা খুলে দেয়। আধুনিক যুগে রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার জটিলতা ও সংকটকে বোঝার জন্য তাঁদের চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক, প্রজ্ঞাপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়।
লেখক:
প্রভাষক-রাষ্ট্রবিজ্ঞান
প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী স্কুল এন্ড কলেজ
পশ্চিম রাখালিয়া, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর।
Khan82akhter@gmail.com
৩ ঘন্টা ২৫ মিনিট আগে
৯ দিন ৯ ঘন্টা ৪৯ মিনিট আগে
২০ দিন ৩ ঘন্টা ৩৭ মিনিট আগে
২৯ দিন ২ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
৫১ দিন ১০ ঘন্টা ৫২ মিনিট আগে
৫৭ দিন ৫ ঘন্টা ৮ মিনিট আগে
৫৮ দিন ৫ ঘন্টা ৮ মিনিট আগে
৬২ দিন ১৪ ঘন্টা ৪৩ মিনিট আগে