ঘুরে ফিরে ওই মাছই খাই, আমরাতো আর গরুর গোস্ত খাইতে পারি না, যে দাম বাড়ছে তাতে রমজানেও ব্রয়লার মুরগি খাওয়া হবে না। রোজগারের কর্মক্ষম ব্যক্তি কাজ না পেয়ে বাড়িতে ফিরে আসার সময় সোনালীনিউজের সাথে কথা বলতে গিয়ে নিজের ক্ষোভের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার গুঞ্জনখাঁ গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব জরিনা বেগম।
বছর পাঁচেক আগে উপার্জনক্ষম ছেলের মৃত্যুর পর জরিনার সংসারে নেমে আসে নিদারুণ কষ্ট। বৃদ্ধ স্বামী একদিন কাজে না গেলে চুলায় হাড়ি উঠাতেও ভাবতে হয় তাকে। এখন সংসারে দুবেলা-দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তায় অনেক হিসেব কষতে হয় তাঁকে।
সোমবার (২০ মার্চ) রংপুরে রাত থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল দুপুর ২টার দিকে জরিনার বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে চালের হাড়ি বসিয়েছেন তিনি। ভাতের পর চুলোয় বসবে তরকারির হাড়ি। তবে কী রান্না করবেন তখনো অজানা? কারণ তার স্বামী বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফেরেনি বাড়িতে।
এরকম পরিস্থিতিতে জরিনা বেগমের কাছে জানতে চাওয়া ব্রয়লার মুরগি কেনা হয় কিনা- উত্তরে তিনি বলেন, তিনদিন ধরে আমার স্বামীর কাজ নেই। সকালে বের হয়েছে। কাজ জুটলে পাতে ভাত-তরকারি জুটবে। এখন আমরা মুরগি খেতে পারি না, মাঝে মধ্যে মুরগির ছাড়ানো চামড়া এনে রান্না করি। সব সময় ব্রয়লার মুরগি খাওয়া সম্ভবও নয়। আমাদের আবাদ-সুবাদ নেই, গরিব মানুষ। তাতে আবার মাসে মাসে কিস্তির যন্ত্রণাতো আছেই।
শুধু কি জরিনা বেগম? এঅবস্থা এখন প্রায় সব দরিদ্র পরিবারের। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোরও একই চিত্র। তাদের ভাতের থালায় ‘ব্রয়লার’ এখন লাপাত্তা। বছরের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে এখন তা ২৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও আবার ২৫০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হচ্ছে। যা বেশির ভাগ পরিবারের কাছেই অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লাফিয়ে দাম বাড়ার পেছনে খামারি ও ব্যবসায়ীরা বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। সঙ্গে রয়েছে পোল্ট্রি ফিড, মুরগির বাচ্চা, মেডিসিন, পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি শীত মৌসুমে উৎপাদন কম হওয়ারও কারণ। বর্তমানে বাজারে ব্রয়লার মুরগির আমদানিও কম বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। রমজানের ঠিক আগে যদি এমন দাম হয়, তাহলে রমজান মাসে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন সাধারণ ক্রেতারা।
রংপুর নগরীর বর্ধিত এলাকা রঘু বাজারের আলুর জমিতে দিনমজুরি করা আফজাল হোসেনকে মাংস কবে খেয়েছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘গরুর গোস্ত হামার মতন মানুষ খাবার পায় মাঝে মধ্যে ব্রয়লার মুরগি খাচনো সেটাও আর হওচে না। যে দাম বাড়ছে ব্রয়লার মুরগি তো হামার মতো গরিবের পাত থাকি উঠি গেইছে, আর প্যাটোত যাবার নায়। মুরগি কিনবার চাইলে ডাইল-ভাত খাওয়া হবার নায়।’
সচেতন ক্রেতারা মনে করছেন, দুদিন বাদেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। প্রতি বছর রমজানকে উপলক্ষ করে মাংসের দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু এবার প্রায় দুই মাস আগেই তা বাড়তে শুরু হয়েছে, যাতে কোনো ধরনের সমালোচনার মুখে পড়তে না হয়। সোমবার রংপুরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেশি মুরগি খুচরা ৫৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়া সোনালি মুরগি ছিল ৩৫০ টাকা কেজি, ব্রয়লার মুরগি ২৫০ টাকা কেজি, লেয়ার ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লারের কেজিতে ৫০-৬০ টাকা দাম বাড়ার দাবি করে সিটি বাজারের ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বলেন, দুদিন আগে সোনালি মুরগি ৩৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি, আর আজ সেই মুরগি পাইকারদের কাছে ৩৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ব্রয়লারের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গতকালের ব্রয়লার আজকে কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। ২৩০/৪০ টাকায় কিনে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করছি। বাজারের যে পরিস্থিতি আমাদেরও শান্তি নেই, কাস্টমারও হিমশিম খাচ্ছে।
পীরগাছার হাউদারপাড় গ্রামের খামারি রিয়াজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, বাজারে মুরগির দাম বেশি। আমরা খামারিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। আমার মতো প্রান্তিক খামারিদের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো জিম্মি করে রেখেছে। আমরা নিজেরা চাইলেও কিছু করতে পারছি না। সব কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনভাবে দাম বাড়িয়েছে এখন খামার ধরে রাখাটাই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পোল্ট্রি শিল্প মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে রংপুর জেলায় ছোট-বড় মিলে মুরগির খামার ছিল প্রায় ৭ হাজার। এর মধ্যে লেয়ার মুরগির খামার ৩ হাজার এবং ব্রয়লার মুরগির খামার ছিল ৪ হাজার। তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৫ সালে লেয়ারের খামার কমে এক হাজার ৯৩টি আর ব্রয়লার মুরগির খামার ২ হাজারে দাঁড়ায়। বর্তমানে সরকারি খাতা-কলমে সেই সংখ্যা ১ হাজার ২২৮টিতে দাঁড়ালেও পোল্ট্রি শিল্প মালিকরা বলছেন, এক হাজারের নিচে মেনে এসেছে খামার।
রংপুর জেলা পোল্ট্রি শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেনের সাথে কথা হয় এই বিষয়ে তিনি বলেন, শুরুতে অনেক শিক্ষিত বেকার তরুণদের হাত ধরে সম্প্রসারিত হতে থাকে এই শিল্প। তখন লক্ষাধিকেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান ও ভরসার জায়গা ছিল পোল্ট্রি শিল্প। কিন্তু সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণে দফায় দফায় বেড়েছে পোল্ট্রি ফিডের দাম। ব্যাংক ঋণে জটিলতাসহ মুরগির রোগ প্রতিরোধের ব্যর্থতায় প্রতি বছরেই জেলায় কমছে খামারের সংখ্যা।
পোল্ট্রি শিল্পের ভবিষ্যৎ খারাপের দিকে যাচ্ছে। যে খামার গড়ে উঠেছিল, তার চার ভাগের তিন ভাগই গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পুরো শিল্পটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তাদের ঘাড়ে। হঠাৎ করে একলাফে ব্রয়লারের তিনগুণ দাম বেড়ে গেল। যে খাবারের দাম ছিল ৩৫ টাকা এখন তা ৭২ টাকা। এভাবে প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সরকার মাঝে-মধ্যে ভর্তুকি দিচ্ছে, আমদানি ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ করে দিচ্ছে। কিন্তু এর সুফলটা ঘুরে ফিরে সিন্ডিকেট চক্রই পাচ্ছে। সাধারণ খামারি কিংবা সাধারণ ভোক্তাদের কোনো কল্যাণ হচ্ছে না।
প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্র বলছে, ১ হাজার ২২৮টি মুরগির খামার আছে রংপুরের আট উপজেলায়। এর মধ্যে ৪৭৩টি লেয়ার এবং ৪৯৫টি ব্রয়লার খামার। এসবের মধ্যে ৭৫টি লেয়ার এবং ২৩৫টি ব্রয়লারের খামার অনিবন্ধিত। বাকি সবগুলো সরকারি নিবন্ধিত খামার। গত বছরের এই পরিসংখ্যান থেকে বেশ কিছু খামার বন্ধ হয়ে গেলেও তার সঠিক কোনো তথ্য নেই বলেও জানিয়েছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি।
রমজানের আগেই এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে দাবি করে রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সিরাজুল হক বলেন, মুরগির বাচ্চা, খাবার, মেডিসিনের দাম বাড়ার সঙ্গে বিশ্ববাজারের প্রভাব পড়েছে। বাচ্চা মারা যাওয়ার ভয়ে অনেক খামারি শীতের সময় উৎপাদন কমিয়ে দেন। এর প্রভাবে বাজারে আমদানি কম হওয়ায় ব্রয়লারের দাম বেড়েছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার পর দিনমজুর শ্রেণির মানুষগুলোর আমিষের ওপর আঘাত এসেছে। এসব মানুষ আগে সপ্তাহে দুইবার মুরগি খেলেও এখন একদিন খেতেই হিমশিম খাচ্ছে। হু-হু করে দাম বাড়তে থাকায় নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের পাত থেকে ব্রয়লার যেন উঠেই যাচ্ছে। এখন মুরগির মাংসের বদলে মুরগির চামড়া-পাসহ অবশিষ্ট অংশেই ঝুঁকছেন বেশির ভাগ দিনমজুর পরিবার।
সূত্র: অনলাইন ডেস্ক
১৫ ঘন্টা ৩৭ মিনিট আগে
১ দিন ১২ ঘন্টা ৩ মিনিট আগে
১ দিন ১৪ ঘন্টা ৫১ মিনিট আগে
২ দিন ৩৭ মিনিট আগে
২ দিন ৩৯ মিনিট আগে
২ দিন ৪০ মিনিট আগে
২ দিন ১৩ ঘন্টা ২৯ মিনিট আগে
৩ দিন ১৮ ঘন্টা ৪০ মিনিট আগে