◾প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল : আত্মহত্যা মহাপাপ, প্রত্যেকটি ধর্মমতেই আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আত্মহত্যা কি সবকিছুর সমাধান হতে পারে? আত্মহত্যার মাধ্যমে কি জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়?প্রতিনিয়ত কম বা বেশি এমন ঘটনা দেশের আনাচে-কানাচে ঘটে থাকে; পত্র-পত্রিকার বদৌলতে ঘরে বসে সহজেই জানতে পারি।
কখনও কি ভেবে দেখেছেন আপনার আশপাশে থাকা একজন বিকলাঙ্গ মানুষ বা গরিব দিনমজুর জীবনের প্রতিকূলতার মাঝে থেকেও খুশি মনে কীভাবে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে? অথচ আপনি সামান্য কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য আত্মহত্যার কথা ভাবছেন! বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে গেলে দেখা যায় কতো নিরীহ মানুষ বেডে শুয়ে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।অথচ আমরা সুস্থ থাকার পরও কিঞ্চিৎ পরিমাণ কারণের জন্য নিজের জীবন নিজ হাতেই শেষ করে দিতে কুণ্ঠিতবোধ করছি না।
দেশে প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এই শিক্ষিতদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতিতে মন্দাসহ সমাজে যখন বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যখন মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে, তখন আত্মহত্যার হারও বাড়ে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকে আবার বাধ্য হয়েও আত্মহত্যা করে; যেমন- দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা অনেক সময় আত্মহত্যা করে। অসুখের তীব্র যন্ত্রণা সইতে না পেরে এ পথ বেছে নেয়।
আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজে ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম কষ্ট ও যন্ত্রণা দেয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানো। আমাদের বাংলাদেশে অনেক নারী-পুরুষ বিশেষত যুবতী বোনেরা জীবন সংগ্রামের পরিবর্তে জীবন থেকে পালিয়ে যাবার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
জীবনে ভালোকিছুই করতে পারলাম না, আশেপাশে সবাই তরতর করে এগিয়ে গেলো, আমি পড়ে থাকলাম তলানিতে। পরীক্ষার ফলাফলটা খারাপ হলো, বাবা-মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হলো, ভালো কোনো চাকরি জুটলো না ভাগ্যে। ভালো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে চাকরি পাচ্ছি না,সমাজে মুখ দেখাবো কিভাবে এইসব ভেবেই আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এদিকে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গেও বনিবনা না হওয়ায় সম্পর্কটাও টিকলো না। হতাশা আর দুশ্চিন্তায় মনে হলো বেঁচে থাকা এতো কঠিন? এরচেয়ে তো মরে যাওয়াও সহজ। ব্যস, এর থেকেই মনে দানা বাঁধতে লাগলো আত্মহত্যার চিন্তা।
সম্প্রতি আমাদের সমাজে আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের অভিভাবক সমাজ তাদের সন্তানদের বর্তমান জীবনবোধকে কেন্দ্র করে বেশ উদ্বিগ্ন। অত্যন্ত তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে সন্তানদের স্বচেতনায় আত্মহনন সদৃশ অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বর্তমান হালচাল প্রাজ্ঞ সমাজ থেকে সাধারণ মানুষের নিকট আজ মাথা বেদনার বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
যেসব কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, এর অন্যতম হচ্ছে বুলিং। চরম হতাশা ও অসহায় বোধ থেকে কিশোর-কিশোরীরা এই পথে পা বাড়ায়। মাদকাসক্তের মতো সমাজবিরোধী আচরণও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায়। বাংলাদেশে যেসব পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, সেগুলো হলো- সাইবার ক্রাইমের শিকার, যৌতুক প্রথা, বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকা, পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, চাকরি হারানো, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব, দরিদ্রতা, প্রতারণার শিকার, ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতি, প্রিয়জনের মৃত্যু,পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পাওয়া, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের তাচ্ছিল্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক, ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব, যৌন সহিংসতা এবং নির্যাতনের শিকার হওয়া ইত্যাদি।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে সেশনজটে পড়ে পিছিয়ে যাওয়া, চাকরি পাওয়ার অনিশ্চিয়তা, পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা এইসব কারণে বিষন্নতা তৈরী হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। যা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।
প্রতি বছর বিশ্বে বিভিন্ন দেশের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। গবেষকদের মতে প্রায় ২৭% থেকে ৯০% এরও বেশি মানুষের আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক অসুখের সম্পর্ক থাকে। মানসিক চাপে বা কোনো দুর্ঘটনার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণে হঠাৎ করেই আত্মহত্যা করে বা চেষ্টা চালায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতাটা বেশি লক্ষণীয়। বিচ্ছেদ, আর্থিক সংকট, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, পেশাগত কাজে ব্যর্থ, তীব্র মানসিক চাপ, হতাশা, জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলা, বিষণ্নতা এবং উদ্বিগ্নতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এখন প্রশ্ন হলো- কেন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী যারা আগামী দিনের বাংলাদেশ পরিচালনা করবে তারা এই ভয়ঙ্কর মানসিক ব্যাধির শিকার হচ্ছে। এই সংক্রান্ত কারণ খুঁজতে গিয়ে আরও উদ্বেগজনক কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছেন গবেষকরা।
২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে স্কুল পর্যায়ে ৩৪০, কলেজে ৪৪৬ জন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৪ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। পরিসংখ্যান বলছে- নারীদের আত্মহত্যার সংখ্যাই বেশি। স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী রয়েছেন ৬০.৯০% এবং পুরুষ রয়েছেন ৩৬.১%। শুধু স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যাকারী নারী শিক্ষার্থীর পরিমাণ ৬৫.৩% এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৩৪.৭%। শুধু কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যাকারী নারী ৫৯.৪৪% এবং পুরুষ ৪০.৫৬% রয়েছে।
এক জরিপ থেকে জানা যায়, ২০২১ ও ২০২২ সালে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রুয়েটেরই ১১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। একটি জরিপ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এর আগে একই সংস্থার করা জরিপ বলছে, করোনাকালীন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে যাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করছে, সেই তারাই জীবনের কাছে হার মেনে বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।
চলতি বছরে ৮ মাসে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ১৯৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী। ৭৬ জন কলেজপড়ুয়া, ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এবং ৪৪ জন।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে যত আত্মহত্যা ঘটেছে, তার ৫০ শতাংশের কারণ হতাশা। হতাশা এমন একটা অবস্থা, যা মানুষকে তার জীবনের রস উপভোগ করতে দেয় না। একাকিত্বে ভোগায়। আবেগীয় মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করতে না পারায় হতাশার চরম পর্যায় একজন মানুষকে সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার করে ফেলে; যার ফল রূপ নেয় আত্মহত্যায়। অথচ আত্মহত্যাকে না করেও জীবন থেকে হতাশা শব্দটাকে বিদায় জানানো যায়।
আত্মহত্যার প্রবণতা যাদের মধ্য দেখা যায়, তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিন। তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। বাঁকা কথা, নেতিবাচক মন্তব্য, মুখ সরিয়ে নিলে নিজেকে এ পৃথিবীতে একা ভাবতে পারে। তার কেউ নেই—এ চিন্তা যেন মনের মধ্যে গেঁথে না বসে। তাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। মেয়েটিকে আত্মহত্যার পথ থেকে সরিয়ে আনতে পাছে লোকে কিছু বলে, সামাজিক মর্যাদাহানি এ রকম পুরোনো চিন্তা-চেতনা থেকে পরিবারের সদস্যদেরও বের হয়ে আসতে হবে।
জীবনে সফলতা মানেই কোন সমস্যা ছাড়া বেঁচে থাকা নয়। ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করে, নিজের কথা ভেবে, পরিবারের কথা ভেবে আত্মহত্যার চিন্তা পরিহার করে বেঁচে থাকার নামই সফলতা।
প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল
লেখক ও সংগঠক
১ দিন ১৬ ঘন্টা ৩৬ মিনিট আগে
১ দিন ১৬ ঘন্টা ৪২ মিনিট আগে
৫ দিন ১৫ ঘন্টা ৫৬ মিনিট আগে
৫ দিন ২৩ ঘন্টা ৪০ মিনিট আগে
৭ দিন ৯ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
৭ দিন ২০ ঘন্টা ৩৫ মিনিট আগে
৯ দিন ১৪ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে
১০ দিন ১ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে