মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের কড়া হুঁশিয়ারি ওবায়দুল কাদেরের দুই বিভাগে হতে পারে বৃষ্টি সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত ৬ কে হচ্ছেন শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান.? নন্দীগ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ২ জনের জরিমানা ঝিনাইদহের উদয়পুর পবহাটি এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে হাফেজ ছাত্রকে বলাৎকারের বিষয়ে পাল্টাপাল্টি মামলা নলছিটি কৃষি ব্যাংকে উৎসবমুখর পরিবেশে হালখাতা উদযাপন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মামলা,কালিগঞ্জ রিপোর্টার্স ক্লাবের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ তীব্র তাপদাহে নাকাল জনজীবন, সারাদেশের ন্যায় সুন্দরগঞ্জে বৃক্ষরোপণ করলো ছাত্রলীগ। জয়পুরহাটে ১৬ টি স্বর্ণের বারসহ চোরাকারবারি আটক রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে হিট স্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু। অবৈধ মাটি উত্তোলনের দায়ে অভিযুক্তকে লাখ টাকা জরিমানা বে-টার্মিনালের ৪টি টার্মিনালই বিদেশি বিনিয়োগে হবে - বন্দর চেয়ারম্যান মাতামুহুরি নদীতে নিখোঁজ সেই দুই জেলেকে মৃত উদ্ধার জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করতে চশমা মার্কা ভোট চাই : ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জুনাইদ সালুয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান একেএম ফরিদ উদ্দিন খান আর নেই নাগেশ্বরীতে চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিতদের মাঝে ভেড়া বিতরণ চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীতে মাছ ধরার ঝাঁক ঘিরতে গিয়ে ২ যুবক নিখোঁজ ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক-স্টেশন মাস্টার গোলাম রব্বানী আবারও টেকনাফে এসে পড়লো গুলি

আনি আরনো : যার উপন্যাসের নোঙর বাস্তবজীবনে প্রোথিত

admin - দেশচিত্র নিউজ ডেস্ক

প্রকাশের সময়: 08-10-2022 11:52:21 am

সংগৃহীত ছবি


◾ফয়জুল লতিফ চৌধুরী 


প্রতিবছর সুইডিশ একাডেমি র্কতৃক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান বাঙালিকে বেশ উদ্বেলিত করে থাকে। এর কারণ এই নয় যে, জাতি হিসেবে বাঙালি খুব সাহিত্যামোদী। বরং বিশ শতকের শুরুর দিকে, ১৯১৩ সালে বাংলা ভাষার প্রধানতম সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ঘটনা শিক্ষিত বাঙালিদের নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একজন বাঙালির শীর্ষস্থানে পৌঁছে যাওয়ার এটাই ছিল প্রথম ঘটনা।


গত একশ বছরে বাংলা ভাষায় অনেক শক্তিশালী কবি ও কথাসাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটলেও প্রয়োজনীয় অনুবাদের অভাবে নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্তির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত রয়ে গেছে। তবে এ কথাও বাস্তব যে, এ মুহূর্তে এমন কোনো জীবিত বাঙালি কবি বা সাহিত্যিকের কথা আমরা ভাবতে পারি না, যার পক্ষে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। এ হতাশাব্যঞ্জক আবহের মধ্যেও নোবেল পুরস্কার নিয়ে বাংলাদেশে মানুষের উৎকণ্ঠা ক্রমবর্ধমান বলে লক্ষ করা যায়। প্রতিবছর অক্টোবরের শুরুতে ‘এবার কে নোবেল পুরস্কার পেতে পারে’Ñএ নিয়ে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি।


এ প্রসঙ্গে আমাদের স্মরণ হয়, ১৯৮৯ সালে পর্তুগিজ লেখক কামিলো হোসে সেলাকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের অব্যবহিত পর দেশ প্রকাশন তার উপন্যাস ‘পাসকুয়েল দুয়ার্তের পরিবার’ বাংলায় অনুবাদ করিয়ে নিয়ে ১৯৯০-এর বইমেলায় প্রকাশ করেছিল। সেই থেকে বিগত তিরিশ বছরে বিভিন্ন ভাষার যত কবি ও সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তার প্রায় সবাই এক বা একাধিক গ্রন্থ বাংলা ভাষায় দ্রুত অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। পৃথিবীর জনপ্রিয়তম জাপানি ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি নোবেল পেতে পারেন- এ বিবেচনায় বিগত দশ বছরে তার দশটি গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছে। এভাবে নোবেল পুরস্কার বাংলাভাষী পাঠককে আন্তর্জাতিক সাহিত্যমহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলেছে। 


২.


গত বৃহস্পতিবার ফরাসি লেখিকা আনি আরনোকে ২০২২ সালের জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণা একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। যদিও বাজিকরদের কোনো একটি তালিকায় তার নাম ছিল, কিন্তু সাহিত্যগুরুদের কারও মনে হয়নি এ বছর নোবেল পুরস্কার শেষাবধি আনি আরনোকে দেওয়া হবে। প্রায় সবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল- ভৌগোলিক বিবেচনায় এ বছর নোবেল শিরোপার গন্তব্য হবে ইউরোপের বাইরে। 


এ বছর জাপানের হারুকি মুরাকামি, কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত সালমান রুশদির নাম ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তবে গত বছর তানজানিয়ার লেখক আব্দুল রাজ্জাক গুরনাহ নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় সঙ্গতভাবেই মনে হয়েছিল যে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো এ বছরও বাদ পড়বেন। আনি আরনোর পরিবর্তে আরও যাদের কথা সাহিত্যগুরুদের মনে ছিল, তারা হলেন কানাডীয় কবি অ্যান কারসন, সিরিয়ার বয়োজ্যেষ্ঠ কবি আদুনিস, দক্ষিণ কোরিয়ার ঔপন্যাসিক হোয়াং সোক-ইয়ং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করম্যাক ম্যাআর্থি, ডন দেলিলো প্রমুখ। মিলান কুন্দেরার নাম এ বছর শোনা যায়নি; সবাই ধরে নিয়েছে, যত কাঙ্ক্ষিতই হোক, যত বড় ঔপন্যাসিকই তিনি হন না কেন, সুইডিশ একাডেমি কখনও তাকে নোবেলের জন্য বিবেচনা করবে না।


১৯০১ সালে ফরাসি কবি ও গদ্যকার সুলি প্রুদোমকে পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন হয়। এরপর যেসব ফরাসি কবি ও লেখক নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে প্রায় সবাই বাঙালি পাঠকসমাজের কাছে সুপরিচিত যেমন মিস্ত্রাল, রম্যাঁ রল্যাঁ, আনাতোঁল ফ্রাঁস, অঁরি বের্গসনর, আঁদ্রে জিদ, আলবেয়ার কাম্যু, সঁ-ঝ পের্স, জঁ-পল সাত্রে, ক্লদ সিমো এবং লে ক্লেজিও। ২০১৪ সালে ঔপন্যাসিক পাত্রিক মোদিয়ানোকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ফরাসিদের গৌরবোজ্জ্ববল এ তালিকায় এ বছর আনি আরনোর নাম সংযুক্ত হলো। 


সুইডিশ একাডেমি সবসময়ই বিশ্বের সাহিত্যামোদীদের একটু চমক দিয়ে থাকেন। গায়ক বব ডিলান বা বেলারুশিয়ার সাংবাদিক আলেক্সিয়েভিচ স্বেতলানাকে নোবেল দিয়ে তারা সাম্প্রতিককালে বিশেষ চমক সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আনি আরনোর বিষয়ে সে কথা বলা যাবে না; কারণ এ লেখিকা ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তার প্রথম গ্রন্থ ‘ক্লিনড্ আউট’-এর পর থেকে ক্রমাগত লিখে গেছেন এবং ফরাসিভাষী বিশ্বে পঠিত হয়ে ক্রমে ক্রমে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘একজন যুবকের গল্প’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চব্বিশ। এ ছাড়াও তার অন্যবিধ ছোটখাটো বহু প্রকাশনা রয়েছে। 


১৯৪০ সালে ফ্রান্সের নরম্যানডিতে একটি সাধারণ শ্রমিক পরিবারে তার জন্ম। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৮০ সালে ১৭ বছরের দাম্পত্য জীবনের পর স্বামী ফিলিপ আরনোর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তার দুটি ছেলেসন্তান রয়েছে, যাদের নাম এরিক ও ডেভিড। 


টাইমস লিটারেরি সাপ্লিমেন্ট তাকে ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় একজন লেখিকা হিসেবে বর্ণনা করেছে। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক জন ব্যানিভল বলেছেন, সাহিত্যজগতে আরনোর লেখালেখি একটি বিপ্লবের মতো, কারণ যে পদ্ধতিতে তিনি লিখে থাকেন, তার কোনো পূর্বজ নেই। তার রচনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আত্মজৈবনিকতা। অতীতের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে তিনি অবলম্বন করেছেন গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য হিসেবে। কিন্তু অতীতকে তিনি দেখেছেন একজন সমাজতাত্ত্বিবকের চোখে। তার ‘দি ইয়ার্স’ গ্রন্থটি ইউরোপের বাইরে বিশেষ সমাদর লাভ করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, এটি এমন একটি আত্মজীবনী, যার মতো আগে কখনও লেখা হয়নি। এতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ফরাসি সমাজের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা তুলনারহিত। কিন্তু শুরুতে অবস্থা এতটা অনুকূল ছিল না। 


ফরাসি লেখিকা আনি আরনো ১৯৯১ সালে প্রকাশ করেছিলেন তার উপন্যাস ‘সহজ কামনা’ (প্যাসন সিম্পল)। ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল : কেবল ফ্রান্সেই এ রকম একটি ক্ষুদ্রাবয়ব আত্মজৈবনিক উপন্যাস পাঠকের কাছে সমাদৃত হতে পারে। উপন্যাসটি ফরাসি পাঠকদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এমনকি ইংরেজিভাষী বিশ্বে তেমন কদর লাভ করেনি। আলোচনায় আরও উল্লেখ করা হয়েছিল : তার অপরাপর দুটি উপন্যাস যথা ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘একজন পুরুষের জগৎ’ এবং ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘এক নারীর কাহিনি’ ফ্রান্সে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোনো সাড়া জাগায়নি। 


কিন্তু ক্রমে পরিস্থিতি অনুকূল হয়েছে। ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘দি ইয়ারস’ ইন্টারন্যাশনাল ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ভাগ্য ক্রমে এতটাই প্রসন্ন হয়ে ওঠে যে, সুইডিশ একাডেমি আনি আরনোকে ২০২২ সালের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফ্রান্স ও অন্যান্য ফরাসিভাষী দেশে এবং ইউরোপে পরিচিত নাম হলেও পৃথিবীর অন্যান্য এলাকায় আনি আরনো এখন পর্যন্ত পরিচিত হয়ে ওঠেননি। আশা করা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এখন তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ হবে এবং সারা বিশ্বে দ্রুত পরিচিতি লাভ করবেন ফরাসি লেখিকা আনি আরনো।


৩.


কৈশোরেই আরনো নিয়মিত দিনলিপি লিখতেন। এভাবে তিনি নিজের লেখালেখির সক্ষমতা সম্যক অনুভব করেছিলেন। ১৯৭২ সালে একদিন তিনি উপন্যাস লিখতে বসে যান। উপন্যাস লিখবেন শুনে তার স্বামী ফিলিপ আরনো ব্যঙ্গর হাসি হেসেছিলেন। তাই স্বামীকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে লুকিয়ে প্রথম উপন্যাসটি লিখেছিলেন আনি আরনো। যখন একটি নামকরা প্রকাশক উপন্যাসটি প্রকাশে সম্মত হলো, তখন তার স্বামী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। 


১৯৭৪ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘ক্লিনড আউট’ নামে। তার জীবনের অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ এবং অনিবার্য গর্ভপাতের কাহিনি, অপমান ও লোকলজ্জার ঘটনাকে অবলম্বন করেছেন তিনি এ উপন্যাসে। পরবর্তী ৪৮ বছরে একে একে তিনি মোট ২৪টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিছু দিন আগে প্রকাশ করেছেন নতুন উপন্যাস ‘একজন যুবকের কাহিনি’। আজ তার অন্যতম পরিচয় এই যে, তিনি একজন আত্মজৈবনিক ঔপন্যাসিক। প্রতিটি উপন্যাসের উপজীব্য স্বীয় জীবনের কড়কড়ে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ। তিনি নিজের জীবনের গোপন এবং প্রকাশ্য খুঁটিনাটি নানা বিষয়কে একেকটি উপন্যাসের জন্য উপজীব্য করেছেন নিঃসংকোচ সাহসিকতায় । 


ষাটের দশকে, যখন তার বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ, তখন ভার্জিনিয়া উলফ পড়ে পড়ে তার মধ্যে লেখালেখির তীব্র ইচ্ছা ঘনিয়ে উঠেছিল। কাছাকাছি সময়ে আঁদ্রে ব্রেটনের ‘ফার্স্ট ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম’ পড়ে জীবন এবং লেখালেখির ও জীবনযাপনের একটি পথরেখার সন্ধান পেয়েছিলেন। জারমেইন গ্রিয়ারের ‘দ্য ফিমেইল ইউনাক’ বইটি তার দার্শনিক চিন্তায় নারীর সামাজিক অবস্থানকে প্রবিষ্ট করে দিয়েছিল। ১৯৬৫-তে প্রকাশিত হয় জর্জ পেরেকের ‘ষাটের গল্প : বিষয়আশয়’। জর্জ পেরেকের রচনাকৌশল তাকে ভাবিয়েছিল। এই সবকিছু তাকে চেনা-পরিচিত জগৎকে নতুন করে উপলব্ধির দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। ভার্জিনিয়া উলফের মতো তারও মনে হয়েছিল লিখতে হলে প্রথমে বর্ণনাতীত বাস্তবকে তীব্রভাবে অনুভব করে নিতে হবে। লেখালেখির লক্ষ্য হবে হৃদয়ের গভীরে অনুভূত বাস্তবকে সাহিত্যের নতুন কোনো ভাষায় উত্থাপন করা। বিশেষ কোনো কাহিনি কল্পনা ফাঁদার প্রয়োজন নেই; উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশেষ কতগুলো চরিত্রচিত্রণের প্রয়োজন নেই। বরং নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা ও অনুভবের মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে- যা কিছু দরকার। এভাবেই তিনি আত্মজৈবনিক কাহিনি রচনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তার রচনা আত্মজৈবনিকতা অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন উপন্যাস। তার রচনার পরিসরে স্মৃতি ও স্মৃতিচারণ, অতীতের আবেগ ও উপলব্ধি, স্বপ্ন ও কল্পনা কখন একে অপরের সীমান্ত অতিক্রম করেছে তা বলা কঠিন। তবে সব লেখলেখির নোঙর বাস্তবজীবনে প্রোথিত রেখেছেন তিনি। সাধারণ মানুষের জীবনের আকাঙ্ক্ষা ও ব্যর্থতা, আদর্শ ও দুর্বলতা, উত্থান ও পতন, দুঃখ ও লজ্জা, অর্জন ও অপমান সবই তার উপন্যাসের কাহিনিতে স্থান পেয়েছে। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার বিষয়ে তার পক্ষপাত রয়েছে। 


কৈশোর থেকে নিয়মিত দিনপঞ্জি লিখেছেন আনি আরনো । দিনপঞ্জিতে অবধৃত ঘটনাবলির অনুপুঙ্খ বর্ণনা তাকে নিজ অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে সাহায্য করেছে। ফ্রান্সের পাঠকমহল উপন্যাসের অবয়বে একজন নারীর অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং পর্যবেক্ষণের অপরিশোধিত পরিবেশনা সাদরে গ্রহণ করেছে। তিনি অক্লেশ জীবনের গোপনতম ঘটনাকে উপন্যাসের কাঠামোতে উপজীব্য করেছেন। তার কাছে উপন্যাস যাপিত জীবনের ইন্টারপ্রিটেশন। 


১৯৮৮ সালে আনি আরনো সোভিয়েত রাশিয়ায় গেলে লেনিনগ্রাদে একজন তরুণ রুশ কূটনীতিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তখন ওই তরুণ রুশ কূটনীতিকের কর্মস্থল প্যারিস। আরনোর বয়স ৪৮, নতুন প্রেমিকের বয়স ৩৫। তাদের ১৮ মাস স্থায়ী প্রেমের কাহিনি নিয়ে ২০০১ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘হারিয়ে যাওয়া’, যা গত মাসে ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ঘনিষ্ঠ মিলনের বর্ণনায় তিনি অকপট যেমন, ‘তিন ঘণ্টায় চারবার করেছি আমরা’, ‘বাৎসায়নের কামসূত্রে আছে এমন কিছু করতে আমরা বাকি রাখিনি’, ‘ওর বীর্যমাখা একটি জি-স্ট্রিং আমি আমার বালিশের নিচে রেখে দেব’। একস্থানে আমরা পড়ি : ‘হঠাৎ খেয়াল করে দেখি আমি আমার একটি কনট্যাক্ট লেন্স হারিয়ে ফেলেছি। ওর বাঁড়ার মাথায় খুঁজে পেলাম অবশেষে’। অকপটভাবে আরনো লিখেছেন: ‘ও আসে, চোদে, ভদকা টানে আর স্তালিনকে নিয়ে বকবক করে’। ─ দিনলিপিতে লিখে রাখা এই কাহিনিই তিনি উপজীব্য করেছিলেন উল্লিখিত ‘সহজ কামনা’ (প্যাসন সিম্পল) উপন্যাসে।


প্রথম উপন্যাস ‘ক্লিনড আউট’-এ যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের কথা বর্ণিত হয়েছে তার একটি অংশ ছিল অনালোকিত। কে ছিল এই অকালে উৎপাটিত ভ্রূণের জনক, সেটি কাহিনির কোথাও উল্লেখ ছিল না। অনেক পরে প্রকাশিত ‘এক তরুণীর গল্প’ শিরোনামীয় উপন্যাসে তিনি কুমারিত্ব বিসর্জন ও অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভসঞ্চারের কাহিনিটি অবারিত করেছেন আনি আরনো। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এটি কোনো ধর্ষণের ঘটনা ছিল না। ধর্ষণের ঘটনা হলে হয়তো অনেক আগেই এ নিয়ে লিখে ফেলতাম।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি বাধা দিইনি, এ কথা স্পষ্ট মনে পড়ে’।


আত্মজৈবনিকতা আনি আরনোর লেখালেখির ভিত্তিমূল। আত্মজৈবনিক উপন্যাস আর আত্মজীবনী এক কথা নয়। আত্মজীবনী একজন মানুষের সমগ্র জীবনের নির্বাচিত স্মৃতি-সংকলন। অন্যদিকে আত্মজৈবনিক উপন্যাসে একজন লেখক স্বীয় জীবনের বিশেষ কোনো স্মৃতি বা ঘটনাকে অবলম্বন করে কাহিনিভাগ রচনা করেন। আনি আরনো সর্বদাই এ বিষয়ে সচেতন। অন্যদিকে আমরা দেখি, তিনি কেবল তার নিজের কথা লেখেননি; যে জনপরিসরে তিনি থেকেছেন, সেই সব মানুষের কথাও তিনি তুলে এনেছেন। ফলে তার কোনো কোনো উপন্যাস আত্মজৈবনিকতার পরিসীমা অতিক্রম করে সামাজিক দর্পণ হয়ে উঠেছে। আদ্যোপান্ত আত্মজৈবনিকতা থাকলেও আনি আরনো তার উপন্যাসগুলোকে সার্বজনীন করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। আর এখানেই তার বিশেষ কৃতিত্ব।


 আরনো তার যে গ্রন্থটির জন্য সম্প্রতি ইউরোপের বাইরে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন, সেটি হচ্ছে ‘দি ইয়ার্স’। ২০০৮ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল, যদিও ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে সাম্প্রতিকালে। বলা হয়েছে দি ইয়ার্স একই সঙ্গে একজন নারীর এবং একটি সমাজের জীবনকাহিনি। ১৯৪১ থেকে ২০০৬ সময়ের এই ব্যাপ্ত পরিসরকে তিনি ধারণ করছেন এই গ্রন্থটিতে। এ সময়ে ফরাসি সমাজব্যবস্থায় নানা আন্দোলনের স্রোত বয়ে গেছে। সমসাময়িক ফরাসি সমাজকে বোঝার জন্য এর চাইতে নির্ভরযোগ্য আর কোনো বই নেই।


লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাহিত্যিক।

আরও খবর
deshchitro-6627268572040-230424090957.webp
উচ্চশিক্ষা অর্জনে শিক্ষকের ভূমিকা

১ দিন ১৪ ঘন্টা ৫০ মিনিট আগে






660820eb14353-300324082547.webp
আলিয়া মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা কোন পথে?

২৫ দিন ৪ ঘন্টা ২২ মিনিট আগে