◾অমিত হাসান || "ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো, বাটাভরা পান দেবো গাল ভরে খেয়ো" এরকম ছড়া অথবা "এক যে ছিল রাজা। রাজার সাত রাণী। ছোট রাণী, মেঝ রাণী, সেঝ রাণী....." অথবা "হাউমাউখাউ মানুষের গন্ধ পাউ..." এরকম গল্প বা লোককথা শুনে নি বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এমন মানুষ হয়ত খুব একটা পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে এমন শতশত ছড়া, কবিতা, গল্প, গান। যা লোকমুখে প্রচলিত হতে হতে সুদূর অতীত থেকে এসে পৌঁছেছে বর্তমানে। আর বাংলা সাহিত্যেও সৃষ্টি হয়েছে স্বতন্ত্র একটি শাখা- বাংলা লোকসাহিত্য। মূলত লোকসাহিত্য হলো সাহিত্যের সেই শাখা যে শাখাটি তার সর্বজনীনতা ও সর্বকালীনতার গুণে পুরাতন হয়েও চিরনতুন। সাহিত্য সমালোচকেরা বলে থাকেন লোকসাহিত্য বুদ্ধিপ্রসূত কোনো একজনের ভাবনা নয় বরং তা আবেগ অনুভূতিজাত সমষ্টি মনের ফসল। এটি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্টি হয়ে লোকমুখে বিস্তৃতি লাভ করে। তারপর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় দূর থেকে দূরান্তে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, "মুখে মুখে যাহা ছড়াইয়াছে তাহাই লোকসাহিত্য।" আবার রুশ লোকসাহিত্যবিদ ওয়াই. এম. সকোলভ এর মত হলো, "লোকসাহিত্য (Folklore) অতীতের প্রতিধ্বনি এবং একইসাথে বর্তমানের প্রবল কন্ঠস্বর।" এটি একটি জাতির সাংস্কৃতিক সম্পদ। ছড়া, গল্প, গীতিকা, লোকসংগীত ছাড়াও লোকমুখে প্রচলিত ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, কিংবদন্তি, রুপকথা, উপকথা, ইতিকথা, ব্রতকথা, নীতিকথা, ভৌতিক কথা ইত্যাদিও লোকসাহিত্যের অংশ।
জানা যায় ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরাই প্রথম এই বাংলা লোকসাহিত্যগুলো সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। জেমস লঙ, উইলিয়াম মর্টন কিংবা জর্জ গ্রিয়ারসনদের অবদানের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। পরবর্তী সময়ে সাময়িক পত্রগুলোও নিজেদের পুরনো শিল্প-সংস্কৃতি খুঁজে বের করে সংগ্রহ করার গুরুত্ব অনুধাবন করতে থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও প্রচার- প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগীন্দ্রনাথ সরকারদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছেলেভোলানো ছড়া', যোগেন্দ্রনাথ সরকারের 'খুকুমণির ছড়া', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'টুনাটুনির বই', দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ' ঠাকুরমার ঝুলি', 'ঠাকুরদাদার ঝুলি 'এবং 'ঠাকুরদিদির ঝুলি' ইত্যাদি গ্রন্থগুলো বাংলা লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
বলা হয়ে থাকে, লোকসাহিত্য একটি জাতির অতীতকে দৃশ্যমান করে তোলে। কাজ করে অতীতের সাথে বর্তমানের সেতুবন্ধন হিসেবে। এই লোকসাহিত্য অত্যন্ত প্রাচীন। আর এর রচয়িতা যেহেতু সাধারণ মানুষ নিজেরাই তাই এতে সমসাময়িক জনসাধারণের চিন্তা-চেতনা, আশা- আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ -বেদনা ফুটে ওঠে। তাই সংগৃহীত লোকসাহিত্য একটি জাতিকে তার উত্থান -পতনের ইতিহাস, ঐতিহ্য, চিন্তা- চেতনা এবং শিল্প- সাহিত্য সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ আভাস দিতে পারে। যাতে করে পুরনো অভিজ্ঞতাকে নতুন করে কাজে লাগানোর সুযোগ পাওয়া যায়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ও লোকসাহিত্য সংগ্রহ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত পল্লিসাহিত্য প্রবন্ধে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর মতে, "পল্লির ঘাটে মাঠে, পল্লির আলোবাতাসে, পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে। কিন্তু বাতাসের মধ্যে বাস করে যেমন আমরা ভুলে যাই বায়ু সাগরে ডুবে আছি, তেমনি পাড়াগাঁয়ে থেকে আমাদের মনেই হয় না যে কতো বড়ো সাহিত্য ও সাহিত্যের উপকরণ ছড়িয়ে আছে। "
একথা অনস্বীকার্য যে আমাদের লোকসাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এর জন্মভূমি গ্রামে হলেও শহরে লোকসাহিত্য কোনোভাবেই অপরিচিত কিছু নয়। যে কারণে লোকসাহিত্য প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন হলেও এর একটা সর্বজনীন আবেদন আছে। আছে জনপ্রিয়তা। তাই একাবিংশ শতাব্দীর এই সময়টাতে এসেও লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা একটুও কমে নি।
• অমিত হাসান
লেখক ও সংগঠক
৬ ঘন্টা ৫২ মিনিট আগে
৯ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
১৩ ঘন্টা ৭ মিনিট আগে
৫ দিন ৮ ঘন্টা ৮ মিনিট আগে
৭ দিন ২১ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে
৮ দিন ২ ঘন্টা ৯ মিনিট আগে
৮ দিন ১৬ ঘন্টা ৩৫ মিনিট আগে
৯ দিন ৮ ঘন্টা ১১ মিনিট আগে