◾কাজী ফারজানা আফরীন
জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে মানুষকে বেছে নিতে হয় উপার্জনের বিভিন্ন পথ। ইসলামের দিকনির্দেশনা হলো—হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করা। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যে উৎসাহ প্রদান করেছে এবং এর ফজিলতের কথাও শুনিয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গী হবেন।’ (তিরমিজি: ১২০৯) মহানবী (সা.)-কে সর্বোত্তম উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘নিজ হাতের কামাই এবং হালাল ব্যবসার উপার্জনই সর্বোত্তম।’ (মিশকাত: ২৭৮৩)
মহান আল্লাহ ব্যবসার জন্য কিছু নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যা না মানার কারণে অতীতে অনেক জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। যেমন প্রাচীন মাদায়েন সম্প্রদায়ের কথা পবিত্র কোরআনে আলোচিত হয়েছে। তারা ওজনে কম দিত, রাহাজানি ও লুটপাট করত, অন্যায়ভাবে জনগণের সম্পদ ভক্ষণ করত। আল্লাহ বলেন, ‘আর মাদায়েনবাসীর প্রতি তাদের ভাই শোয়াইবকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপাস্য নেই। আর মাপে ও ওজনে কম দিয়ো না, আজ আমি তোমাদের সমৃদ্ধিশালী অবস্থায় দেখছি; কিন্তু আমি তোমাদের ব্যাপারে সর্বগ্রাসী দিনের শাস্তির ভয় করছি।’ (সুরা হুদ: ৮৪) তারা শোয়াইব (আ.)-এর কথা অমান্য করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে নেমে আসা কঠিন আজাব, অগ্নিবৃষ্টি ও প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সবাই ধ্বংস হয়ে যায়।
সৎ ও হালাল পন্থায় ব্যবসা করতে হলে ব্যবসায়ীদের কিছু নীতিমালা মেনে চলা আবশ্যক। কেননা, এ ক্ষেত্রে বৈধ ও অবৈধের বিষয়টি ইসলামে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা ইসলামসম্মত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে—
▪️প্রতারণা পরিহার
ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রতারণা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। মহানবী (সা.) পণ্যে ভেজাল দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন নবী করিম (সা.) কোনো এক শস্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শস্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তাঁর হাত ভিজে গেছে। তিনি বললেন, ‘হে শস্যের মালিক, ব্যাপার কী?’ উত্তরে শস্যের মালিক বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে।’ মহানবী (সা.) তাকে বললেন, ‘তাহলে ভেজা অংশ শস্যের ওপরে রাখলে না কেন—যাতে ক্রেতারা তা দেখে কিনতে পারে? নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম: ১০২; মিশকাত: ২৮৬০)
▪️ভেজাল পরিত্যাগ
ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্যদ্রব্য, পণ্যসামগ্রী ও পানীয়তে ভেজাল মেশানো একটি মারাত্মক অপরাধ। যারা এসবে বিষ দেয় এবং ভেজাল মেশায় তাদের ভাবা উচিত, দুনিয়ায় মানুষকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও মহান আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা (অবাধ্যতার মাধ্যমে) আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে খিয়ানত কোরো না এবং জেনেশুনে তোমাদের পরস্পরের আমানতসমূহে খিয়ানত কোরো না।’ (আনফাল: ২৭) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘মানুষকে তাদের জিনিসপত্র কম দিয়ো না।’ (সুরা শুআরা: ১৮৩)
▪️সুদ বর্জন
ব্যবসায়-বাণিজ্যের মাধ্যমে যে মুনাফা অর্জিত হয় তাতে সম্পদ বা মূলধন বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধি ইসলামে উৎসাহিত করা হলেও সুদের ভিত্তিতে মূলধনের বৃদ্ধি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষের ধনসম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার উদ্দেশে তোমরা যে সুদ নিয়ে থাকো, তা আল্লাহর দৃষ্টিতে অর্থসম্পদ বৃদ্ধি করে না।’ (সুরা রুম: ৩৯) অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসা হালাল এবং সুদ হারাম করেছেন।’ (বাকারা: ২৭৫)
▪️মিথ্যা শপথ পরিহার
মহানবী (সা.) ব্যবসার মধ্যে অধিক শপথ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। বিশিষ্ট সাহাবি ওয়াসিলা ইবনুল আকওয়া (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাদের কাছে আসতেন এবং বলতেন, ‘হে বণিক দল, তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে।’ পণ্য বেচাকেনার সময় সব ব্যবসায়ীর মিথ্যা শপথ বর্জন করতে হবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন—যে তার ব্যবসায়িক পণ্য মিথ্যা শপথ করে বিক্রি করে।’ (মুসলিম: ১০৬)
▪️মজুতদারি থেকে বিরত থাকা
মজুতদারির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অনেক মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। তাদের কষ্ট বেড়ে যায়। তাই ইসলাম এ প্রকার কাজকে হারাম ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুত রাখে, আল্লাহপাক তার ওপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ: ৫৫)
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নেওয়ার সময় বেশি নেওয়া এবং দেওয়ার সময় কম দেওয়া মারাত্মক অপরাধ। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের ধ্বংস অনিবার্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা ওজনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা যখন লোকজনের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয়, তখন পুরোপুরি নেয়। আর যখন তাদের মেপে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা সেই কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে, যেদিন সব মানুষ আপন প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে?’ (সুরা মুতাফ্ফিফিন: ১-৫)
সুতরাং সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। অবৈধ উপার্জনের লোভ-সংবরণ করতে হবে। আর এটাই আল্লাহর পরীক্ষা।
লেখক: কাজী ফারজানা আফরীন
সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৩ দিন ১৯ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে
৪ দিন ২১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট আগে
৭ দিন ৪৮ মিনিট আগে
১০ দিন ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট আগে
১৩ দিন ৩ ঘন্টা ৩৫ মিনিট আগে
১৩ দিন ১২ ঘন্টা ৩১ মিনিট আগে
১৩ দিন ১৩ ঘন্টা ১৮ মিনিট আগে
১৪ দিন ৩৮ মিনিট আগে