◾উবায়দুল ইসলাম
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশীদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ, যুদ্ধসহায়তা দিয়েছে। যুদ্ধে ৩হাজার ৯০০জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। ১৯৭৪সালে সীমান্ত চুক্তি ও ২০১৫ সালে নানা অমীমাংসিত সীমান্ত চুক্তিও সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখন পযর্ন্ত থামেনি ভারতের বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স)কর্তৃক সীমান্ত হত্যা!
গেল ০৭সেপ্টেম্বর দিনাজপুরের দাইনুর সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক মিনহাজ(১৯)নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং আরও দুইজন, এমদাদুল(২৮) ও সাগর(২০) এখনও নিখোঁজ। ঐসময় কর্মরত ২৯ব্যাটেলিয়ানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনাটি ঘটে এমন রাষ্ট্রীয় উদ্বিগ্ন মুহুর্তে যখন প্রধানমন্ত্রী ভারতে সফরে গেছেন এই সব বিষয়ে মীমাংসা করতে। এর মধ্যে জানা যায় হত্যাকান্ডের আগেরদিন মোদি সরকার সীমান্ত হত্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন এবং তা শূন্যের ঘরে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ - ভারত সীমানা ৪,১৫৬ কি.মি.বা ২,৫৮২ মাইল আন্তর্জাতিক সীমানা অংশে ভাগ করে। এটি বিশ্বের ৫ম দীর্ঘতম ভূমি সীমানা। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সীমান্ত হত্যাকান্ডের ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে এটি এখন 'রক্তাক্ত সীমান্ত' বলেও পরিচিত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২থেকে ২০২০সাল পযর্ন্ত সর্বমোট ১৮৬০জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী এবং আহত হয়েছেন ১১৪৫জন বাংলাদেশী, অপহৃত হয়েছেন ১৪০৮জন, নিখোঁজ হয়েছেন ১১১জন, ধর্ষণ হয়েছেন ১৫জন, পুশ-ইন করা হয় ৩৬৪ জন বাংলাদেশীকে।এছাড়াও ২০২১ সালে সীমান্তে হত্যা করা হয় ১৮জন বাংলাদেশীকে। ২১জুলাই, ২০২২সালে বিবিসি নিউজে বলা হয়, ২০১৫সাল থেকে ২০২২সাল পযর্ন্ত ২২১জন বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয় এবং আহত হয়েছেন ২৫০জন। যদিও এ সময়টায় আওয়ামী সরকারের সাথে ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তবুও সীমান্ত হত্যা কান্ড আশানুরুপ কমে নি। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকের উপর বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা করা পৃথিবীর একটি মাত্র সীমান্তেই সম্ভব আর তা হলো বাংলাদেশ - ভারত সীমান্ত। পৃথিবীর অন্য কোন দেশের নাগরিকের উপর আক্রমণ বা হত্যা করা হলে তার বিচার না হওয়া পযর্ন্ত সে দেশের সাথে সব রকমের সম্পর্ক স্থগিত করা হয়, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, সীমান্তে সামরিক মহড়াসহ নানা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় কিন্তু বাংলাদেশ - ভারতের সাথে এমন ঘটে না। জাতি,ধর্ম, আদর্শ, সার্বভৌমত্ব আলাদা হলেও আমরা কেন জানি ভারতের সামনে প্রভু প্রভু চিত্তে নত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সীমান্ত হত্যাকান্ডের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে ২০১১সালে ৭জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়িয়ার অনন্তপুর সীমান্তে ফেলানী হত্যাকান্ড। হত্যার পর ৫ঘন্টা সীমানার কাটাতারের উপর ঝুলিয়ে রাখা হয়। শুধু হত্যায় নয় অমানবিক নির্যাতন, পশুত্ব সুলভ আচরন করেন। তবে এখন পযর্ন্ত ফেলানীর হত্যার কারণ বা অপরাধ জানা যায় নি। পরে কলকাতা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন সীমান্ত হত্যা উদঘাটন নিয়ে ভারতের হাইকোর্টে মামলা করেন। মামলায় আসামি বিএসএফ সেনা অমিত ঘোষকে মুক্তি দিলে ; পরে তারা সুপ্রিমকোর্টে বিচার চাইলে তদন্তের সময় নিয়ে নানা টালবাহানায় এখনো কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয় নি আদালত। তারপর থেকে বিচার চাওয়া তো দূরে থাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে প্রশ্ন করলেও তা এড়িয়ে যান। এভাবেই শেষ হয়ে যায় হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের উপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা অনেকটাই নির্ভর করে। এ বিষয়টিও হাওয়াই উড়িয়ে দেওয়ার মতো না। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিবে সরকার প্রয়োজনে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে কিন্তু আজব বিষয় হলো বাংলাদেশের সরকার এ বিষয়টি সব সময় এড়িয়ে চলেন। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি জানালে বিষয়টি সমাধানের পথ পাবে কিন্তু এমন কিছুই হয়নি বিগত বছরগুলোতে।
এদিকে ১৭-২১ জুলাই,২০২২ সীমান্ত সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন বিএসএফ মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং। তিনি বলেন, সীমান্ত এলাকায় সবগুলো ঘটনা ঘটে রাতে এবং যেসব হতাহতের ঘটনা ঘটে তারা সবাই অপরাধী। এ সম্মেলনের পরের মাসে ২৪আগস্ট পঞ্চগড়ের অমরখানা সীমান্তে আব্দুস সালামকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা ও ৩১আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিংনগর সীমান্তে ভেদু নামে একজন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ বাহিনী।
অন্যদিকে ভারত দাবি করে অবৈধ চোরাচালান, অবৈধ অভিবাসন, জাল মুদ্রা ও বিস্ফোরক পরিবহন, যৌনকাজের জন্য মানব প্রাচারের সময় এসব ঘটনা ঘটে। এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে সীমান্ত হত্যার কারণ উল্লেখ করে বলেন, সীমান্তে শূন্যরেখার কাছে জমি চাষাবাদ, কাজ খোজার জন্য সীমান্ত পারাপার, সীমান্তবর্তী নদীতে মাছ আহরণ, হাট বাজারে বেচা কেনা, আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে যাওয়ার সময় শ্যূট অন সাইট (দেখামাত্র গুলি) ব্যবহার করেন। এই নীতি সম্পূর্ণ মানবতা বিরোধী, পৃথিবীর কোন ইতিহাসে এমন কোনো নিয়ম লেখা নেয় যে সীমান্ত সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে গুলি করতে হবে। একজন সাধারণ বেসামরিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা পৃথিবীর সকল আইনকে অবমাননা করা ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সামিল। ভারত যেসব অপরাধ দেখিয়ে হত্যাকান্ড পরিচালনা করে তার সিংহভাগই বানোয়াট প্রমাণিত হয়। ২০১১সালে হিউম্যান রাইটস ওয়্যাচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, সীমান্তে মানুষের উপর অত্যধিক বল প্রয়োগ ও নির্বিচারে প্রহার অসর্মথনীয়। এইসব নির্যাতনের ঘটনা ভারতের আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বাংলাদেশ ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার' অভিযোগ করেন, সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ কর্তৃক ধর্ষণ ও লুটপাটের স্বীকার হয়েছেন এলাকাবাসী। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া মহাদেশের নির্বাহী পরিচালক ব্যাড এডামস বলেন, বিএসএফের আচরণ এবং শ্যূট অন সাইট নীতি বাতিল করতে নতুন আদেশ পাঠালেও ভারতে এখনো তা বাস্তবায়ন করে নি। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো সব সময় সোচ্চার থাকলেও ভারত যেন এ বিষয়টি কানেই নিচ্ছেন না। ফলে বেড়েই চলেছে মানবতাবিরোধী সীমান্ত হত্যা কান্ড। বাংলাদেশের সাথে মোদি সরকারের সম্পর্ক অনেকটা ঘরোয়া ঘনিষ্ঠের মতো হলেও এ বিষয়ে বরাবরের মতোই উদাসিন বিজেপি সরকার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সাতটি বিষয়ে সমঝোতা হয়ে সীমান্তহত্যার কথা উঠে এ হত্যাকান্ড শূন্যের ঘরে আনার আশ্বাস দেন। ঠিক তার একদিন পরেই দিনাজপুরে এ ঘটনাটি ঘটে! অবশেষে বুঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত হত্যাকান্ড হয়তো চলতেই থাকবে যতদিন থাকবে বাংলাদেশ - ভারতের সীমানা। ভারতের সাথে সীমান্ত আছে পাকিস্তান ও চীনের। এদের সীমানায় বিএসএফ কর্তৃক গুলি করে বেসামরিক সাধারণ মানুষ হত্যা ইতিহাসে বিরল।
আমেরিকা - মেক্সিকোসহ ইউরোপের প্রায় সকল দেশের সাথে পরস্পর ভূমিসীমানা থাকলেও বাংলাদেশ - ভারতের মতো প্রতিবছর এত বেশী সীমান্ত হত্যাকান্ড কখনো ঘটে নি।
লেখক: উবায়দুল ইসলাম
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক
১ দিন ১৩ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে
৭ দিন ৭ ঘন্টা ২৮ মিনিট আগে
৮ দিন ৭ ঘন্টা ২৮ মিনিট আগে
১২ দিন ১৭ ঘন্টা ৩ মিনিট আগে
১৫ দিন ১ ঘন্টা ৫ মিনিট আগে
২১ দিন ১৩ ঘন্টা ১ মিনিট আগে
২২ দিন ৬ ঘন্টা ০ মিনিট আগে
২৩ দিন ৩ ঘন্টা ৩২ মিনিট আগে