ডিবি কার্যালয় থেকে বের হয়ে যা বললেন মামুনুল হক এবার এক লাফে যত বাড়ানো হলো স্বর্ণের দাম নওয়াপাড়া মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শতভাগ পাস, শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা বিচ্ছুর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত। জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত নাফনদী থেকে দুই কাঁকড়া শিকারীকে অপহরণ করেছে আরসা আবহাওয়া অধিদপ্তর যা জানাল সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ নিয়ে বিশ্বকাপে টাইগাররা কে কোথায় ব্যাটিং করবেন, জানিয়ে দিলেন পাপন কোম্পানীগঞ্জে আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীর গণসংযোগ সাংবাদিক প্রবেশের বিষয় স্পষ্ট করলো বাংলাদেশ ব্যাংক কংগ্রেসম্যানদের সই জালকারী বিএনপি একটা জালিয়াত রাজনৈতিক দল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন কারিকুলামে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে স্কুল কমিটি ও অভিভাবকদের মতবিনিময় কুড়িগ্রামে বিশ্ব উচ্চরক্তচাপ দিবস পালিত কক্সবাজার পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণরত শিক্ষিকার মৃত্যু গলাচিপা উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ১৫ জন ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করা হবে। পাঁচবিবি উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি রুহুল আমিন সম্পাদক জুয়েল শেখ নির্বাচিত ঈশ্বরগঞ্জে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ উপলক্ষে র‌্যালি ও আলোচনাসভা সিরাজগঞ্জ পৌরসভার কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি হান্নান খান, সম্পাদক আল আমিন বরিশাল স্টেডিয়ামকে একটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামে পরিণত করা হবে-- প্রতিন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম (এমপি) বরিশাল নগরী বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে ট্রাফিক পুলিশের সচেতনমূলক অভিযান।

কুমারী পূজা ও যুগভাবনা

ফাইল ছবি


স্বামী দেবধ্যানানন্দ 


কুমারী তো সামান্য, সাধারণ বালিকামাত্র। তাকে আবার পূজাবেদিতে বসিয়ে পূজা করা কেন? আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছে কুমারী ও কুমারী পূজা সাধারণ-সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের অসাধারণ উপলব্ধিপ্রসূত সহজ-সরল কথাটি আমাদের ভক্ত হৃদয়ে একবার মনে করা যাক। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন--সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক-একটি বিশেষ রূপ। শুদ্ধসত্ত্ব কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ বেশি। সেজন্য কুমারী পূজা করা হয়।’


প্রেমাস্পদ জগজ্জননীর প্রকাশ বেশি যে সত্তায়, সেটি ভক্তের পূজা ও উপাসনার শ্রেষ্ঠ প্রতিমা--এ কথা বলাই বাহুল্য। কুমারী পূজার বিশেষত্ব হলো--প্রচলিত অর্থে কাঠ, মাটি বা পাথরের প্রতিমা, অথবা কোনো প্রতীকের সাহায্যে এই উপাসনা করা হয় না। চেতন কুমারীতে চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরের উপাসনা। অবশ্য যথার্থ ভক্ত চাইলে মৃন্ময় প্রতিমাতেও ঈশ্বরের চিন্ময়স্বরূপ প্রত্যক্ষ করতে পারেন। ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তিকে মাতৃরূপে উপাসনা করা সনাতন অধ্যাত্ম সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য। কুমারী পূজার উৎস ও ক্রমবিকাশ বিষয়ে জানার আগ্রহ আছে যাদের, তাদের জন্য বেদ-পুরাণ-তন্ত্রের কিছু তথ্য-ব্যঞ্জন না হয় পরিবেশন করা যাক। বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দেবীকে কুমারী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে--‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারী ধীমহি তন্নো দুর্গি : প্রচোদয়াৎ।’ বৃহদ্ধর্ম পুরাণ আমাদের জানাচ্ছেন, দেবী অম্বিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হয়ে বেলগাছে দেবীর বোধন করার নির্দেশ দেন। কুমারী পূজার মাহাত্ম্য কীর্তন করে তন্ত্র বলছেন--কুমারী পূজা ছাড়া হোম প্রভৃতি কর্মে পরিপূর্ণ ফল পাওয়া যায় না। কুমারী পূজা দ্বারা হোমাদি কর্মের কোটি গুণ ফল লাভ হয়। কুমারীকে একটি ফুল দান করলে সুমেরু পরিমাণ ফল প্রাপ্তি হয়। কুমারীকে ভোজন করালে ত্রিলোকবাসী সবাইকে ভোজন করানো হয়।’ 


যেকোনো প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠে দেবীকে কুমারীরূপে পূজা করা ঐসব পীঠস্থানের একটি বৈশিষ্ট্য। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজায় অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজা প্রবর্তন করেন। পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যেকোনো কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারীকন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত হলেও কোথাও বলা নেই যে ব্রাহ্মণকন্যাই কেবল পূজ্য। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোল বছর বয়সি যেকোনো কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়। অনেকের মতে দুই বছর থেকে দশ বছরের মেয়েদের পূজা করা যায়। শাস্ত্রমতে দুর্গাপূজার অঙ্গানুষ্ঠান হিসেবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী বা এর যেকোনো দিন কুমারী পূজা করা যেতে পারে। এক থেকে ষোল বছরের বালিকারা ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত কুমারী পূজার যোগ্য। বয়সভেদে কুমারীর বিভিন্ন নাম, যেমন--সন্ধ্যা (১ বছর), স্বরস্বতী (২ বছর), অম্বা (১৬ বছর)। কুমারীকে বস্ত্রালংকারে সুসজ্জিত করে, বিধিমতো নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে পাদ্য, অর্ঘ্য, ধূপ, দীপ, গন্ধ, পুষ্প, নৈবেদ্য ইত্যাদি ষোড়শোপচারে বাহ্যপূজা করা হয়। আবার হৃদয়ে ধ্যানের মাধ্যমে মানসপূজাও করা হয়। কুমারীর সেই ধ্যানমন্ত্রটি অনুধ্যান করা যাক : ‘যিনি ত্রিনয়নী, চন্দ্রশোভিত যার মস্তক এবং দেহকান্তি তপ্তকাঞ্চনতুল্য; যিনি নানাবিধ অলঙ্কারবিভূষিতা, রক্তবস্ত্র ও রক্তমাল্য পরিহিতা এবং রক্তচন্দনাদি দ্বারা চর্চিত যার দেহ; যার বাম ও দক্ষিণ হস্তদ্বয় যথাক্রমে বর ও অভয় প্রদানের জন্য প্রসারিত--সেই পদ্মাসীনা কুমারীকে ধ্যান করি।’ হিন্দুধর্মে বলা হয়--দেবকী কুমারী প্রতীকে হিন্দুদের মাতৃরূপে অবস্থিত। সর্বব্যাপী ঈশ্বরেরই মাতৃভাবে আরাধনা করার জন্য কুমারী পূজা করা হয়। আবার কুমারী পূজার মাধ্যমে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নিজেকেই শ্রদ্ধা জানায়। 


কুমারী পূজা তথা ঈশ্বরীয় মাতৃপূজার তন্ত্রোল্লিখিত ফল কেউ লাভ করেছেন কি না, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান আমাদের নেই। কিন্তু ঈশ্বরের মাতৃরূপের পূজার মাধ্যমে রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, শ্রীরামকৃষ্ণের মতো মহৎ ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিহাসে অনেক মহৎ ব্যক্তি কুমারী গুণকীর্তন করেছেন। তাদের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অমিত আধ্যাত্মিক সম্পদের কাছে শাস্ত্রোল্লিখিত ফল নিতান্তই তুচ্ছ বলেই মনে হয় যথার্থ ভক্তদের কাছে। পূজা মানে দেনা-পাওনা নয়। পূজার মূল উদ্দেশ্য আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে। পূজা মানে ভালোবাসা। যথার্থ ভক্ত তাই কিছু পাবার আশায় পূজা করেন না। ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি পূজা করেন। অন্যদিকে সাধক ভক্তরা পূজাকে দিন বা তিথিবিশেষে সীমিত রাখার পক্ষপাতী নন। তারা এর অন্তর্নিহিত ভাবকে নিত্য মনন, দৈনন্দিন ব্যবহার ও নিজ কর্মে এর প্রয়োগের ব্যাপারে যত্নশীল হয়ে থাকেন। তাদের কাছে শ্রীশংকরাচার্য বিরচিত ‘সৌন্দর্য লহরী’র সেই শ্লোকটি বেশ আদরণীয়--‘মা, আমার কথামাত্র তোমার জপ হোক, অঙ্গুলিচালনামাত্রই তোমার পূজার মুদ্রা হোক, আমার চলামাত্র তোমার প্রদক্ষিণ হোক, আমার ভোজনাদিক্রিয়া তোমার আহুতি হোক, আমার শয়ন হোক তোমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম, আমার নিখিলশক্তিসংযোজিত সুখ আত্মসমর্পণ হোক। আমার কার্যমাত্র হোক তোমার পূজা।’ 


অধ্যাত্ম চেতনায় নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের উপাদানসমূহের সঙ্গে যারা কমবেশি পরিচিত, তারা প্রত্যেকেই সমাজ উন্নয়ন ও সামাজিক সমস্যা নিরসনে সেসব মূল্যবোধের চর্চাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। যেকোনো উন্নত সমাজ নির্দিষ্ট আদর্শ অনুসারেই পরিচালিত হয়। একটু ভেবে দেখলে আমরা বুঝতে পারি, ব্যক্তি বা সমাজজীবনে আমরা আসলে আমাদের অন্তরের আদর্শকেই সম্মান জানাই। সেটিকে অর্জন করার জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালাই। এই প্রয়াসের প্রতিফলন আমাদের বাহ্যিক ব্যবহারেও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো সংগীতপ্রেমী বা সংগীত-শিক্ষার্থী যখন সংগীতে পারদর্শী কোনো ব্যক্তিত্বের সামনে শ্রদ্ধায় নতজানু হন, তখন তিনি আসলে ব্যক্তিকে নয়, তার সংগীত প্রতিভা ও শৈলীকেই সম্মান জানান; অতঃপর কীভাবে নিজের জীবনে সেই প্রতিভার বিকাশ হবে, তার প্রয়াস চালান। কুমারী পূজায় আদর্শ ও মূল্যবোধের বিষয়টি আছে কি? ‘কুমারী’ সমগ্র নারীজাতির ও মাতৃভাবের প্রতিভূ। মাতৃভাব মানে কোনো কোমলতা, দুর্বলতা নয়; অন্যের কষ্টকে অনুভব করার শক্তি ও তদনুরূপ ব্যবহার। অর্থাৎ যিনি মাতৃভাবরূপ আদর্শ অনুশীলন বা লালন করবেন তিনি সমাজে অন্যের বেদনায় পীড়িত হবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল হবেন। এক্ষেত্রে তার সমন্বয় দৃষ্টি থাকবে এবং সমাজের সকলের সঙ্গে তিনি প্রীতিপূর্ণ আচরণ করবেন। এই কাজটিই পরিবারের মা ভিন্ন ভিন্ন মত-রুচি-প্রকৃতির সন্তানদের সঙ্গে করে থাকেন। শরীরগত মাতৃত্বে নারীর একচেটিয়া অধিকার থাকলেও আধ্যাত্মিক মাতৃত্বে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের অধিকার রয়েছে। যখন কোনো প্রতিষ্ঠানে বা সমাজে কারও ব্যক্তিত্বে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সহানুভূতি ও সমদৃষ্টির মনোভাব ফুটে ওঠে, তখন তিনি মাতৃভাবাপন্ন ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেকের কাছে সমাদৃত হন। কুমারী পূজা বা কুমারীকে সম্মান জানানো মানে সমগ্র নারী জাতিকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান। শুধু তাই নয়, এই পূজার মাধ্যমে উল্লিখিত মাতৃভাবের বিকাশও সম্ভব হয়। শৈশব থেকে এ পূজার অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনকে যেমন পবিত্র ও উন্নত করা যায়, তেমনি সমাজজীবনে নারী ও শিশুর প্রতি ‘সহিংসতা ও ব্যভিচার’ নামক সামাজিক ব্যাধিও দূর করা যেতে পারে। এ সঙ্গে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জীবনে মাতৃভাব বিকাশ ও সমাজের সকলের সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নকেও এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে।


কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো--নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। তন্ত্রে কুমারীকে বলা হয়েছে যোগিনী বা পরমদেবতা। কামরূপ কামাখ্যা ও কন্যাকুমারী--এ দুই পীঠস্থানের নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কোনো দেশের নাগরিক যখন জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানান, তিনি শুধু ওই পতাকাকেই নয়, দেশ ও জাতির চেতনাকেই সম্মান জানান। সেই চেতনাকে নিজের ব্যবহার ও কর্মে প্রকাশ করার প্রয়াস চালান। প্রাচ্য সমাজে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার ও কর্মে ধর্মীয় বা অধ্যাত্ম চেতনার সুস্পষ্ট প্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেজন্য শাস্ত্রীয়-কর্মানুষ্ঠান, তত্ত্বে বিরামহীন অবগাহন--এসবে সীমিত রাখতে হবে পূজাকে, বিষয়টি মোটেও এমন নয়। পূজা মানে উৎসব-আনন্দ, সে বিষয়টিই বা বাদ যাবে কেন? তাই নতুন পরিধানে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা, নাড়ু, মোয়া, পিঠা-পুলি, পায়েসসহ রকমারি সুস্বাদু খাবারের আয়োজন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে সেসবের আস্বাদন, নাচ-গান, হই-হুল্লোড়--এসব সামাজিক আয়োজনও পূজার আয়োজনে থাকা চাই। 


লেখক : মহারাজ, রামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা।




আরও খবর