মক্তবে পড়তে আসতো অনেক শিষ্যরা। বেশ আবদার ছিল তাদের কালেভদ্রে গল্প শুনার। গল্প বেশে হইলো প্রশ্ন-উত্তরের আসর। কেউ শিখলো। কেউ জানলো। কেউ বুঝলো আর কেউ কাঁদলো।
একদা ভোরের পাখিদের সাথে জেগে ওঠা কতক শিষ্য মক্তবে আসলো। আমি মক্তবের ভিতরে শায়িত ছিলাম। শিষ্যরা সালাম দিয়ে কপাটে আঘাত করে বন্ধ দুয়ার খোলার আহবান জানালো। আমি সালামের উত্তরে দুয়ার খুলে দিলাম। নিরবচ্ছিন্নে প্রবেশ করলো মক্তবে। রীতি অনুযায়ী মক্তবে ঝাড়ু দিয়ে বসে গেল সারিবদ্ধভাবে। আমি ও পুনরায় অযু কালাম করে বসে গেলাম জায়নামাজে।
আজ বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে বাতিগুলো আলোহীন। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। দোয়ার বাতায়নে আলোর প্রবেশ খুবই অল্প। রিমঝিম বৃষ্টির শব্দে সবাই যেন খোদা মহিয়ানের অপরূপ সৃজন উপলব্ধি করতেছে। উষ্ণে নিদ্রাহারা পাখিগুলো ও ডানা ঝাপটাচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজবে বলে।পুকুরের মাছগুলো ঘনঘন গা ভাসাচ্ছে নতুন পানিতে খেলবে বলে ।
শিষ্যদের মন ভাল না থাকা সত্ত্বেও সবাই নিজ নিজ সবক পড়তেছে সামান্য আলোতে। আমি সবার চেহারা লক্ষ্য করলাম দীর্ঘক্ষণ ধরে। বুঝলাম তাদের পড়তে অসুবিধা হচ্ছিল কিন্তু আমি নিশ্চুপ থাকলাম। কিছু বলার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে কেউ কেউ আমার চোখে চোখ মিলাচ্ছে।
একপর্যায়ে আমি বলে উঠলাম, তোমরা কি কিছু বলতে চাও?
তারা সবাই মনের আনন্দে এক সুরে একতালে বলে উঠলো হুজুর!
"গল্প"
আমি বললাম,
গল্প?
তারা বলল, জি হুজুর, আজ সুন্দর একটি গল্প শুনতে চাই।
শিষ্যরা আমার অবুঝ আর নাছোড় বান্দাবান্দি ।শিষ্যরা নড়েচড়ে বসলো তাদের কথাই সাড়া দিলাম বলে। এবং বহুদিন ধরে চাওয়া আবদার আজ পূরণ হতে যাচ্ছে।তাদের আনন্দ তো স্বাভাবিকই হওয়ার কথা।
আমি বামেতরের এক শীষ্যকে প্রশ্ন করলাম, জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি তোমার? সে বুঝতে না পেরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আরেকটু খুলে বললাম, জীবনে কি হতে চাও? সে খানিকটা সহাস্যে বললো, আমি পুলিশ হইতে চাই। আমি পুলিশ হওয়ার হেতু জানতে চাইলে তার কাছে সে বললো, আমি সমাজের অবৈধ কার্যকলাপ ও চোর দমন করবো এবং নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবো। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম এবং বললাম আল্লাহ তোমার নেক ইচ্ছা পূরণ করুক আমিন। অতপর জিজ্ঞেস করলাম তার পছন্দের খাবার কি? জীবনের স্মরণীয় ঘটনা, পছন্দের ব্যক্তিবর্গ, সে নিজের মতো করে উত্তর দিল।
পরেরজনকে বললাম তোমার জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি?
সে বলল হুজুর আমি ডাক্তার হতে চাই। আমি বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললাম, কেন?
সে বলল।
আমি ডাক্তার হয়ে আমাদের পল্লীতে একটি বড় হাসপাতাল তৈরি করবো এবং সেখানে গরিব-দুঃখী মানুষের ফ্রি চিকিৎসা করাবো। আমি পূর্বের মতো তার কাছেও পছন্দের জিনিসের হদিস করছিলাম সেও নিজের মতো করে উত্তর দিল।
পরের জনকে বলার আগেই বললো, হুজুর!
আমি একজন আলেম হবো। আমি বললাম, হওয়ার পর?
সে বলল, আমি সবাইকে কোরআন শিখাবো, হাদিস শিখাবো, আমি বললাম শুধু কি এতটুকুই?
সে বললো, আরো অনেক কিছু। আমি বললাম দু একটা বললে কেউ তোমার স্বপ্ন চুরি করবে না।
সে বললো, হুজুর! আমি সবাইকে শরীয়াহ অনুযায়ী চলতে বলবো। হারাম হালাল এর পার্থক্য বুঝাবো। সত্য মিথ্যার ফজিলত আর ভয়াবহতা বুঝাবো। আমি মাশাআল্লাহ বলে পরের জনের দিকে দৃষ্টি দিলাম।
তাকে বললাম তুমি কি হবে? সে দুহাত উপরে তুলে বললো, হুজুর! আমি পাইলট হবো। আমি হেসেই বললাম, আকাশে ডানা ছাড়া উড়তে পারে, পাইলট হতে যাবে কেন? সে বললো, হুজুর! আকাশ পথে স্বপ্নহীন মানুষ ভ্রমণ করতে পারেনা। আমি স্বপ্নবাজ মানুষের মাঝে বাঁচতে চাই। আমি তো রীতিমতো অবাক তার যৌক্তিত কথা শুনে।
এভাবে প্রায় সবার কাছে নিজ নিজ স্বপ্নের,পছন্দের খাবার, পছন্দের ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে কেউ খেলোয়াড়, কেউ গায়ক, কেউবা ধনী হওয়ার স্বপ্নের কথা আমাকে বললো যৌক্তিক বা অযৌক্তিকভাবে। হেসে বিস্ময়ে প্রায় সবার হেতু ও শুনে ফেললাম যার যার স্বপ্নের।
পরিশেষে আমি আমার এক বিচক্ষণ শিষ্যকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার জীবন তরীর কুল কোথায়? সে উত্তরে বললো, হুজুর! আমি একজন আইনজীবী হবো। বরাবরের মতো বললাম, কারণ? সে বললো, হুজুর আমি কি একটু ব্যাখ্যা করে বলতে পারি? আমি বললাম, হুম অবশ্যই।
সে বললো ,
আমাদের পাড়ার এক অভদ্র ছেলে ছিল। সে প্রায় সময় নেশা করতো। পরে সে পাড়ার মসজিদের ইমামের বয়ান শুনে আল্লাহর রহমতে ভালো হয়ে যায়। আস্তে আস্তে ধার্মিক হওয়াতে পাড়ার সবাই তাকে ভালবাসতে লাগলো। সে সবাইকে সাহায্য সহযোগিতা করতো। একদল তাকে ঘৃণাও করতো, এত অল্প সময়ে তার বদলে যাওয়াতে।
একদিন তার সাথে ঝগড়া পাকালো এক অসভ্য। ফলে সে আঘাতপ্রাপ্ত হলে এলাকার প্রাথমিক হাসপাতালে তার চিকিৎসা করানো হয় । এরপর সে একজন পুলিশের কাছে গিয়ে তার নামে নালিশ দিলো। আদালতে বিচারের দিন তার আইনজীবী মোটা অংকের অর্থ চাইলে দিতে না পারায় তার পক্ষে সঠিক প্রমাণ দিলো না বরং বিপরীত দিক থেকে তাকে ফাঁসিয়ে দিলো। সে লাঞ্ছিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।পরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করে।
তার এই ঘটনা শুনে কেউ হা করে তাকিয়ে আছে আর কারো চোখের কোনায় দু-এক ফোটা অশ্রু কণা জমে গেছে।
সে বললো, হুজুর!
আমি সেই দিনের আইনজীবী হতে চাই, যেদিনের আদালত থেকে বাদী-বিবাদী ন্যায় প্রাপ্যটা পেয়ে আদালতের কপাট বন্ধ করবে। আমি বললাম অবশ্যই ইনশাআল্লাহ ।
এবার মক্তব খানিকটা নিস্তব্ধ ছিল। কারো নড়াচড়াও নেই। সবাই শুধু এক পলকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তো বুঝতে পেরেছি যে, তারাও আমার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই।
আমি যখন বললাম, কি? কিছু বলবে? একজন বললো, হুজুর!
আপনার লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি? আমি বললাম, শুধু আমিই না পৃথিবীর সকল শিক্ষাগুরোর লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো শিষ্যকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া ।
বলতে না বলতেই আরেকজন বললো, হুজুর! আপনার পছন্দের খাবার কি? আমি বললাম, কেন? তুমি এনে খাওয়াবে? সে বললো, হুজুর বলেন না! আমি বললাম মায়ের হাতের সব রান্নাই আমার পছন্দের ।
আরেকজন বললো আপনার পছন্দ-অপছন্দের ব্যক্তিবর্গে কারা ?
আমি বললাম, একজন মা আমার কাছে অধিক পছন্দের যে কিনা তার ছেলের বউকে নিজের মেয়ের মত দেখে ।
একজন বোন আমার কাছে অধিক পছন্দের যে কিনা তার স্বামীর মাকে নিজের মায়ের মত দেখে ।
সবাই মুচকি হেসেই বললো, হুজুর! আমরা ভালোভাবে বুঝিনাই। আমি বললাম, সংসার সুখী হয় রমণীর গুনে। নারীই মা, নারীই বোন, নারীই প্রিয়তমা, আবার তাদের ক্রোধের অনলে জ্বলেই সংসার পুড়ে ছাই হয় ।
অন্য একজন বললো, আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কি হুজুর!? আমি বললাম, ছোটবেলায় খেলার মেলায় মেতে থাকলেও রাতের বেলাটা কিন্তু মাকে জড়িয়ে ধরেই কাটাতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে মায়ের বিছানা থেকে আমাদের বিছানাটাও কত আলাদা হয়ে গেল, মন চাইলেও মাকে একটু জড়িয়ে ধরার সুযোগটা হয়ে ওঠেনা। একদিন আমাদের ঘরে কেউ ছিলনা শুধু মা একাই ছিল। মায়ের কিছুদিন ধরে মাথা ব্যথা ছিলো। একরাতে আমি মক্তবে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম মায়ের কথা। ঘুমের পরী গেল অচিনপুরে। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাবা চাকরি থেকে খবর দিলো, তোর মায়ের মাথাব্যথা অনেক বেড়ে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাইতে হবে। আমার ঘর আর মক্তব অনেক দূরেই ছিলো। আমি খবর পাওয়া মাত্রই শোয়া থেকে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আলো জ্বালানোর পরেও সব যেন অন্ধকার লাগতেছে। ওল্টা জামা গায়ে দিয়ে দৌড়ে এলাম রাস্তায়। দরজায় তালা লাগিয়েছিলাম কিনা জানা নাই। রাতও অনেক গভীর হলো। কোন যানবাহন নেই রাস্তায় । অবুঝ কুকুর গুলো আমাকে দেখে রাতের চোর ভেবে ধাওয়া করলো।অবশেষে বন্ধু সাহায্যের হাত বাড়ালে মায়ের কাছে খুব দ্রুতই পৌঁছে যায়। এবং মাকে দেখামাত্রই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, মা কি হয়েছে তোমার? মা তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। আমার কষ্ট কমানোর জন্য ঐ অবস্থায় ও আমাকে মিথ্যা হাসিতে বলতেছে কই কিছু হয়নি তো! অন্যদিকে মায়ের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। আমার দুই চোখ অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছিলো। কুরআন পড়ে ফুঁ দিতে দিতে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম মাকে।
লেখক: যাইদ আল মারুফ
তরুণ লেখক ও শিক্ষার্থী
২ দিন ২১ ঘন্টা ৭ মিনিট আগে
২ দিন ২১ ঘন্টা ৩৫ মিনিট আগে
৩ দিন ১১ ঘন্টা ২২ মিনিট আগে
৩ দিন ১২ ঘন্টা ১৫ মিনিট আগে
৩ দিন ২১ ঘন্টা ৫৩ মিনিট আগে
৩ দিন ২২ ঘন্টা ৩ মিনিট আগে
৬ দিন ৭ ঘন্টা ১ মিনিট আগে
৭ দিন ২১ ঘন্টা ৩২ মিনিট আগে