◾ আমাতুল্লাহ ফাতেমা || খোকা, ও খোকা! কোথায় গেলি বাবা ? তোমরা আমার খোকাকে দেখেছো? সেই কবে যুদ্ধে গেছে, এখনো ফিরে এলো না। বলে গেছে এবার খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে। কিন্তু এখনো ফিরে নি__সন্তানের খোঁজে দিশেহারা হয়ে পাগলপ্রায় মা কথাগুলো বলছেন।
তিনি আরও বললেন; বাবা, তোকে ছাড়া যে, আমার বড্ড কষ্ট হয়, মাকে একটুও বুঝলি না । এবার আয়, কান ধরে টেনে লাল করে দিব।
তোমরা জানো, খোকা আমাকে কি বলে গেছে? আমার জন্য নাকি কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে আসবে, রক্তে রাঙানো নিশান নিয়ে আসবে!
খোকা! তুই কি আমাকে দেয়া কথাগুলো ভুলে গেছিস? তুই এত নিষ্ঠুর কেন? মায়ের কথা তোর একটুও মনে পড়ে না? পাশের বাড়ির তপু,অনু ও বিপুলসহ সবাই ফিরে এল, তুই কেন এলি না,বাবা ?
তুই আমার কাছে গল্প শোনার জন্য কত বায়না করতি। তোর জন্য কত গল্প সাজিয়ে রেখেছি জানিস?
রাজকুমারের গল্প, সেই গল্পে টুকটুকে সুন্দরী একটা রাজকুমারী আছে আর একটা দৈত্য । রাজকুমার আর দৈত্যটার মাঝে সে-কি তুমুল যুদ্ধ।
তোর কি এখন একটুও আমার গল্প শুনতে ইচ্ছে করে না?
তুই তো আমার ভালো ছেলে, যাদু মানিক।
আয় খোকা, ফিরে আয়। আমার সাথে আর লুকোচুরি খেলিস না ।
সাত রাজার ধন আমার, আমার কোলে ফিরে আয়।
• পথচারী দু'জন যুবকের কাছে গিয়ে হাত বুলিয়ে খোকার মা বলে উঠলো;
__ খোকা, তুই এসেছিস, চল এখন, বাড়ি চল। তোরজন্য ভাত রান্না করেছি। চল। চল না খোকা।
__ কি করছেন? আমি আপনার খোকা না। আমি আপনার খোকা হতে যাব কেন? যত্ত সব পাগলের দল। এসব পাগল যে, কোথা থেকে আসে?
__ তুই আমার খোকা না! ও আচ্ছা, তোর কোথাও লাগেনি তো বাবা? আমার খোকাকে দেখলে বলিস বাবা, যেন তাড়াতাড়ি আমার কাছে ফিরে আসে।
নির্বোধ একটা ছেলে! একটুও বোঝে না! এতোদিন কেউ মায়ের থেকে দূরে থাকে? মায়ের বুঝি কষ্ট হয় না__খোকার মা অভিমানী কণ্ঠে বিড়বিড় করে এসব বলছে।
• কিছু সময় পর খোকার মায়ের কানে ট্রেনের ঝকঝক শব্দ ভেসে আসছে। আওয়াজ শোনে খোকার মা ট্রেনের উদ্দেশ্যে দৌড়াচ্ছে
আর ভাবছে_এই ট্রেনে। হ্যাঁ, এই ট্রেনে। আমার খোকা আসতেছে! আমার সোনা-মানিক,আমার সাত রাজার ধন আসতেছে!
ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানোর পরক্ষণেই খোকার মা যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল;
__ কই? কই আমার খোকা? আমার খোকাকে দেখেছেন? খোকা কি এই ট্রেনে এসেছে?
__ আপনার খোকা কি করে? কোথায় থাকে? আমরা আপনার খোকাকে চিনি না।
__ ওহ! তুমি জানো না! আমার খোকা যুদ্ধে গেছে । এখনো ফিরে আসে নি। এই ট্রেনেই খোকার ফেরার কথা ছিল।
__ আচ্ছা! তাই বুঝি। তবে আপনি এখন বাড়ি যান । আপনার খোকা নিশ্চয় ফিরে আসবে।
__ না। আমি বাড়ি ফিরব না। আমি আমার খোকাকে নিয়ে, তবেই বাড়ি ফিরব!
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা: ওনার খোকা যুদ্ধে গেছে। ১৯৭১ সালে । এখনও ফিরে আসেনি। খোকার মা তাই এখনো খোকার পথপানে চেয়ে আছে। তাঁর খোকাকে ফিরে পাওয়ার জন্য। প্রত্যেক দিন বুকে লালন করে নতুন দিনের স্বপ্ন। রাতে ঘুমের ঘোরে বারবার আঁতকে ওঠে। এই বুঝি তার খোকা দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। এই বুঝি দরজায় এসে বলছে__ মা, ওমা, আমি তোমার খোকা।
তোমার কোলে ফিরে এসেছি। মা দরজা খোলো। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশি মা, ফিরে পাওয়ার আশায় দৌড়ে এসে বারবার অনুসন্ধানি চোখে খুঁজে বেড়ায়। কখনো বা হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। দেখতে না পেয়ে অসহায় মুখে ফিরে আসে।কান্না করতে করতে তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেছে।
তার খোকাকে যে-দিন মেলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছিল, তার কিছুদিন পর খোকার মা খোকাকে দেখতে গেছিল। তখন খোকা বলেছিল- মা! ওরা না আমাকে ভাত খেতে দেয় না। শুধু রুটি দেয়। জানো মা, আমার না খুব ভাত খেতে ইচ্ছে করে।
তারপর দিন খোকার মা রান্না করে নিয়ে গেছিল, খোকাকে খাওয়াবে বলে। কিন্তু খাওয়াতে পারে নি। খোকার মা সেই থেকে এখনো ভাত খায় না। শুধু রুটি খায়। খোকার মা এখনো খাটে ঘুমায় না। কারণ, জেল খানায় খোকা যে, মেঝেতে ঘুমাতো! সে-জন্য খোকার মা এখনো শাড়ির আঁচল পেতে মেঝেতে ঘুমায়।
আপনারা সবাই ওনার খোকার জন্য দোয়া করবেন। ওনার খোকা যেন জান্নাতবাসী হয়। খোকার মার জন্য দোয়া করবেন, যেন উনি সুস্হ-স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন।
আজ এখানেই রাখলাম। যদিও শেষ না হয়ে, হয়ে গেল শেষ।
• কোথা থেকে যেন মহিলা কন্ঠে ভেসে আসতেছে;
_ সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাশে দাঁড়িয়ে,
এক মধ্যবয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে।
_ দৃষ্টি থেকে তার বৃষ্টি গেছে কবে শুকিয়ে,
সে-তো অশ্রু মোছে না, আর গোপনে আঁচলে মুখ লুকিয়ে।
সে-তো শূণ্যে, চেয়ে আছে, আকাশের সীমা ছাড়িয়ে।
• ভেসে আসছে ছেলেকণ্ঠ;
_ মাগো তোর বুকের মানিক আর আসবে না, বাইর দুয়ারে এসে মা ডাকবে না। মায়ারী বাঁধন ছাড়ি, দিয়েছে সে পাড়ি, এমন ভুবনে মা আর আসব না, ও মা। খোকার কথা মাগো পড়লে মনে, তোর চোখের পানিতে মা বুক ভেজাস না। হায়নারা মা তার জীবন নিয়েছে নিতে পারি নি মা মান।
কাঁদিস না মা। আর দুঃখ করিস না। এ জীবনে তোর ছেলের কষ্ট হবে না। ও মা। দেখিস তোকে মানুষ অনেক সম্মান করবে। দেশ সম্মান করবে। মানুষ তোকে মুক্তিযোদ্ধার মা বলবে। তুই হবি মুক্তিযোদ্ধার মা।
৭ দিন ১৮ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে
৮ দিন ৮ ঘন্টা ৩৭ মিনিট আগে
১০ দিন ৭ ঘন্টা ৩৯ মিনিট আগে
১৩ দিন ১০ ঘন্টা ৪৮ মিনিট আগে
১৮ দিন ২১ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে
২৩ দিন ৬ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আগে
২৩ দিন ৭ ঘন্টা ২৬ মিনিট আগে
২৩ দিন ২১ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে