সুশাসনের পথে এক কার্যকর পদক্ষেপ ন্যায়পাল
ন্যায়পাল বা Ombudsman হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। এটি সাধারণত একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করে এবং নাগরিকদের থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। যদিও বিশ্বের অনেক দেশেই ন্যায়পালের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে, বাংলাদেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অভাব লক্ষ্যণীয়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ন্যায়পালের প্রয়োজনীয়তা এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ দিতে হবে— যাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের ক্ষমতার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়। তবে সাংবিধানিক ভাবে এই পদের কথা থাকলেও তা কার্যকর করা যায় নি কখনো৷ অর্থাৎ যাতে তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়।
সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: (১) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন। (২) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যেকোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন। (৩) ন্যায়পাল তাহার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং এই অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে। তবে বাস্তবতা হলো, গত ৫৩ বছরেও একজন ন্যায়পাল নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। ন্যায়পালকে এমন একজন দুর্বল ব্যক্তিতে পরিণত করা হয়েছে যে, কার্যত তার পক্ষে সংবিধানের বিধান মেনে কোনো দায়িত্ব পালনই সম্ভব নয়
ন্যায়পালের মূল কাজ হলো প্রশাসনিক কাজের ত্রুটি দূর করা। কোনো। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ তদন্ত করে সমাধান করা। দুর্নীতি দমন অর্থ্যাৎ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা বা দুর্নীতি প্রতিরোধ করা। সকল ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা আনা। নাগরিক অধিকার সুরক্ষা করে ন্যায়পাল। জনগণ যাতে সঠিক সেবা পায় তা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ন্যায়পালের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রশাসনিক দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি অফিসে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ প্রায়শই হয়রানির শিকার হন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে ন্যায়পাল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ন্যায়পাল প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে। এটি সরকারের কাজের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং সাধারণ জনগণের আস্থার জায়গা তৈরি করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ প্রায়শই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ন্যায়পাল নাগরিকদের সরাসরি অভিযোগ গ্রহণ করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবে। এটি জনগণের সাথে প্রশাসনের দূরত্ব কমাবে এবং তাদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলবে। বাংলাদেশে অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। ন্যায়পাল তাদের কার্যক্রমের উপর নজরদারি করে, দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে পারে।বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়সাপেক্ষ। ন্যায়পাল সেবার মাধ্যমে নাগরিকদের সরাসরি অভিযোগের দ্রুত সমাধান এনে দেয়ার সুযোগ তৈরি করবে।
ন্যায়পালের কার্যকর প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ থাকলেও সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে অনেক জটিলতা কাটানো সম্ভব হতাও। ন্যায়পালের কাজ নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করা। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। ন্যায়পালের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন এবং কার্যকর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা জরুরি। ন্যায়পালকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে।
পাশাপাশি ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট এবং দক্ষ জনবল প্রয়োজন। কিন্তু অনেক সময় এগুলো নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ন্যায়পালের ভূমিকা এবং কাজ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। জনগণ তাদের অধিকার এবং অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত না হলে ন্যায়পালের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।
ন্যায়পালের সাফল্যের জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। পাশাপাশি জনগণের সচেতনতাও দরকার। ন্যায়পালকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যাতে এটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত থাকে। ন্যায়পালের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করা জরুরি, যাতে এটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। ন্যায়পালের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে গণমাধ্যম, সামাজিক প্রচারণা এবং শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
পরিশেষে বলতে হয় বাংলাদেশে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ হতে পারে। এটি প্রশাসনিক দুর্নীতি প্রতিরোধ, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যদিও এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং যথাযথ আইন প্রণয়ন অপরিহার্য, তবুও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ একটি কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা উপহার পাবে। এখন সময় এসেছে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়ার।
রাকিব হাসান
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা