বাংলাদেশে গণতন্ত্র একটি বহুল আলোচিত বিষয়। গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে গেলেও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এর পূর্ণ সুফল পেতে বাধা সৃষ্টি করে। এই চ্যালেঞ্জগুলোকে অতিক্রম করতে না পারলে গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব একটি বড় সমস্যা। ক্ষমতায় আসীন দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র বিরোধ, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস এবং অসহিষ্ণু মনোভাব গণতন্ত্রের জন্য বড় বাধা। রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয়করণ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার উপরও প্রভাব ফেলে। নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে বারবার বিতর্ক এবং সহিংসতা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তার ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে৷ তবে ভোট কারচুপি, প্রভাব খাটানো, এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে জনগণের আস্থা কমে যায়। গণতন্ত্র রক্ষা করার প্রথম শর্তই সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন।
একই সাথে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ঘাটতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিচারহীনতা, দুর্বল প্রশাসন, এবং বিচার ব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্ত করে। যার ফলে দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রায় সব খাতেই প্রবেশ করেছে। প্রশাসন, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে দুর্নীতি গণতন্ত্রের উন্নয়নকে ব্যাহত করে। সুশাসনের অভাব এবং জবাবদিহিতার সংকট জনগণের আস্থাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের শাসনে আরো একটি বড় অভিযোগ গনমাধ্যমের স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যম স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক সময় গণমাধ্যমের উপর রাজনৈতিক চাপ এবং নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে জনগণ সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়।
গণতন্ত্র তখন ই বাধাগ্রস্ত হয় যখন সাংবিধানিক আইন অকার্যকর হয়৷ গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করতে সংবিধান এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব এবং দলীয়করণের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। গণতন্ত্রের অন্যতম লক্ষ্য হলো সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্য। কিন্তু বাংলাদেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য, শহর এবং গ্রামের মধ্যে উন্নয়নবৈষম্য, এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি সুবিধা প্রদান গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। বর্তমানে দেশের প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ।
গণতান্ত্রিক সমাজে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশে অনেক সময় এই স্বাধীনতা সীমিত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন আইন বা বিধি দ্বারা জনগণ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মকে অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। ছাত্র রাজনীতির নামে সহিংসতা এবং দলীয়করণ তরুণদের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে গণতন্ত্রের ক্ষতি করছে। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে কলুষিত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ৷ এছাড়াও, গণতন্ত্রের সফলতার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন এবং সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সুযোগের অভাব গণতন্ত্রকে সীমাবদ্ধ করে।
সুতরাং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা প্রয়োজন। গণতন্ত্র ই সুশাসনের দরজা খুলে দেয়। তাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন,
সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচারব্যবস্থা স্বাধীন করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, বৈষম্যহীন সমাজ, অসাম্প্রদায়িকতা, আইনের শাসন এবং সর্বোপরি জনগণের সচেতনতা।
তবে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এই চ্যালেঞ্জগুলো নিরসন করা সম্ভব হলে গণতন্ত্রের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে। এজন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, এবং প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। গণতন্ত্র কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয়; এটি একটি নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব, যা দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
রাকিব হাসান
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা