◾শাইখ সিরাজ
পৃথিবীর সব মানুষই সাফল্যের পেছনে ছোটে। তবে সাফল্যের সাক্ষাৎ সহজ বিষয় নয়। সাধারণত শিগগিরই হাতে এসে ধরা দেয় না সফলতা। এ বড় সাধনার বিষয়। যাঁরা সফল, তাঁরা সেটা অর্জন করেন তাঁদের মেধা, শ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে। যাঁরা সফল, জীবনসংগ্রামে তাঁরা অনন্য নায়ক। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকার তামাট গ্রামের কৃষক জাহিদ হাসান তেমনই এক নায়ক। তাঁর জীবনের গল্প সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। বছর দুই আগের কথা। তখনো বাংলাদেশে করোনার অভিঘাত শুরু হয়নি। একদিন অফিসে একটা ফোন এল। ভালুকা থেকে জাহিদ হাসান নামের একজন। একেবারে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার! আমার নাম জাহিদ, আফনে যদি একদিন আমার বাগানে আইতাইন! আমার খুব শখ আফনেরে আমার বাগান দেহাইতাম!’ জানতে চাইলাম, ‘কিসের বাগান আপনার?’ বললেন, ‘লেবুবাগান।’ জাহিদের বাগান সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে মিনিট দুয়েক কথা বলে আল্লাহ চাহেন তো কোনো একদিন তাঁর বাগানে যাব—এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফোন রাখলাম।
এরপর শুরু হলো করোনার অভিঘাত। মানুষের সাজানো-গোছানো পরিকল্পনা সব গেল ভেস্তে। এল অঘোষিত লকডাউন। সঙ্গনিরোধকাল। পুরো একটি বছর কোন দিক দিয়ে চলে গেল, কেউ টেরই পেল না। তার পরের বছর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মনে পড়ল ভালুকার জাহিদের কথা। তাঁর ফোন নম্বর রেখে দিয়েছিলাম। ফোন দিতেই ধরলেন। জানতে চাইলাম, ‘কী জাহিদ! লেবুবাগান এখনো আছে? নাকি করোনার কারণে গেছে?’ ফোনের ওপাশে উৎফুল্ল কণ্ঠ, ‘কী কইন, স্যার! বাগান মেলা বড় করছি। আফনে আহইন, দেইখ্যা যাইন। ঢাকা থেকে ভালুকা আর কত দূর!
আমাদের দেশের মানুষের চা খাওয়ার অভ্যাস বেড়েছে ব্যাপক হারে; বিশেষ করে শহরে লেবুর চায়ের চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। চায়ের স্টলগুলো ঘিরেই প্রথম লেবুর বাণিজ্য বিস্তার লাভ করে। আর ক্রমেই বাড়তে থাকে লেবুর চাষ। পরে শহরের মানুষ যখন স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে উঠল, ডাক্তাররা বলতে শুরু করলেন লেবু মেদ কাটে। মানুষ আদাজল খেয়ে লেবুজল খাওয়া শুরু করল। সে ক্ষেত্রেও লেবুর একটা চাহিদা তৈরি হলো। লেবুর অন্য রকম এক চাহিদা তৈরি করেছে করোনা পরিস্থিতি। করোনার শুরুতেই জানা গেল এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে প্রচুর ভিটামিন সি খেতে হবে। যারা আক্রান্ত হবে তাদের তো খেতে হবেই, অন্যদের খেতে হবে ইমিউনিটি বাড়াতে। ফলে এক লাফে লেবুর চাহিদা বেড়ে গেছে বহুগুণ।
যা হোক, লেবু চাষের গল্পে আসা যাক। মনে পড়ে ময়মনসিংহের চররঘুরামপুরে ইব্রাহিম সরকার লেবুবাগান গড়েছিলেন নব্বইয়ের দশকে। তখন ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লেবু চাষের কথা কারও কল্পনায়ও ছিল না। ইব্রাহিম সরকার ছিলেন আত্মবিশ্বাসী এক শৌখিন কৃষক। ২০০৩ সালে হৃদয়ে মাটি ও মানুষের প্রথম শুটিংয়ে তুলে ধরা হয় তাঁর সাফল্যের গল্প। ইব্রাহিম সরকার গত হয়েছেন দেড় দশক আগে। এ এলাকায় তাঁর স্বপ্নের লেবু চাষ ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর। যেমন মনে পড়ছে চরনীলক্ষিয়া গ্রামের কৃষক মাইনুদ্দিনের লেবু চাষে অভাবনীয় সাফল্যের গল্প। শুধু মাইনুদ্দিন নন, তাঁর মতো বহু মানুষই লেবু চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছাসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় লেবু চাষ সম্প্রসারণের খবর তুলে ধরেছি আমার বিভিন্ন প্রতিবেদনে। লেবু চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে টাঙ্গাইল ও নরসিংদী জেলাতেও।
জাহিদ সদাহাস্য এক তরুণ। গ্রামের সরলতা জড়িয়ে আছে তাঁর কথায়। সবুজ ধানখেত। মধ্যে মধ্যে জাহিদের লেবুবাগান। বোঝা যায় ধানের খেতগুলোই পরিণত হয়েছে লেবুবাগানে। ধান চাষে লাভ না পেয়ে অনেক কৃষকই এখন বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। জাহিদ জানালেন তাঁর বাগানের সবই সিডলেস-জাতীয় লেবু। সব মিলে ১৫ বিঘার লেবুবাগান। বাগানের পথ ধরে যত এগিয়েছি, ততই বিস্মিত হতে হয়েছে। প্রতিটি গাছ লেবুতে পূর্ণ। তিন-চারটি খুঁটি দিয়েও লেবুর ভার বহন করতে পারছে না।
বছর দশেক আগেও একেবারে দিনহীন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন জাহিদ। অর্থের অভাবে বাজারে গিয়ে কিছু না কিনে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বহুবার। হৃদয়ে মাটি ও মানুষের একটি পর্বই পাল্টে দিয়েছে জাহিদের চিন্তার পৃথিবী। তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন লেবু চাষ করবেন। সেই শুরু তাঁর সাফল্য অভিযান। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। লেবুতেই ভাগ্য খুলেছে। বলছিলেন জাহিদ, ‘স্যার! এমনও দিন ছিল ঘরে দুই বেলা খাবার ছিল না। আজ আমার সব হইছে।’ বলতে বলতেই ভিজে ওঠে জাহিদের চোখ। জানতে চেয়েছিলাম, ‘লেবু বেচে কী পরিমাণ লাভ পেয়েছেন?
বিশ-ত্রিশ লাখের মতো হবে স্যার।’ লেবু বেচেই ত্রিশ লাখ! অবাক হলাম। তখনো জানতাম না আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। জাহিদ বলছিলেন, ‘বছরজুড়ে আমার বাগানে ২০-৪০ জন লোক কাজ করে। এমনও সময় গেছে প্রতিদিন আমাকে ২২ হাজার টাকা শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়েছে।’ এত টাকা! জানতে চাইলাম এত টাকা কেন? জানালেন, এ বছর তৈরি করেছেন ২০ লাখ লেবুর চারা। বুঝতে পারলাম লেবুর চেয়ে লেবুর চারা বিক্রি করে টাকা পাচ্ছেন জাহিদ। জাহিদই জানিয়েছিলেন, গত বছর ১ কোটি ২০ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন। খরচও আছে। তবে খরচ বাদে বেশ ভালোই লাভ থাকে।
শূন্য থেকে শুরু করে সমৃদ্ধ হয়েছেন। কিনেছেন জমিজমা। এখন তাঁর মোট ৩০ বিঘার বাগান। ১৫ বিঘা মাল্টা ও কমলা আর ১৫ বিঘা লেবু। এর সঙ্গে ২-১ বিঘা পেয়ারা ও কমলা যুক্ত করেছেন। বলছিলেন, টেলিভিশনে এক একটি ফসলের সাফল্যের গল্প শোনেন আর তার পেছনে ছোটেন। জাহিদ ২ বিঘা জমিতে গড়েছেন মাল্টাবাগান। সেখানে ৪০০ গাছে মাল্টা ফলেছে। মহান সৃষ্টিকর্তা জাহিদের হাতে যশ দিয়েছেন। প্রতিটি গাছ ঝুঁকে আছে মাল্টার ভারে। বারি এক জাতের মিষ্টি মাল্টা। জাহিদ জানালেন, বাগান থেকেই তিনি মাল্টা বিক্রি করছেন ৮০-৮৫ টাকা কেজি দরে। এ বছর ৯ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করতে পারবেন। সব মিলে তাঁর খরচ হয়েছে ১ লাখ টাকা। তার মানে ৮ লাখ টাকা লাভ। লক্ষ করলাম, জাহিদের বাগানের সবগুলো গাছের গোড়ায় চুন লাগানো। জানতে চাইলাম চুন লাগানোর কারণ। বললেন, মাল্টার একমাত্র রোগ ক্যাঙ্কার। এ রোগ থেকে রক্ষা করতে তুতের সঙ্গে চুন মিশিয়ে গাছের গোড়ায় লাগিয়েছেন। ফলে তাঁর গাছগুলো বেশ সুস্থ এবং ভালো ফল দিচ্ছে।
জাহিদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কোনটায় বেশি লাভ, লেবুতে নাকি মাল্টায়? জাহিদ জানালেন, লাভ দুটোতেই। লেবুর লাভ আসে বছরজুড়ে আর মাল্টায় লাভ আসে বছরে একবার এক থোকায়। লাভের হিসাব থেকেই বাড়ছে চাষের পরিমাণ। আরও ২৬ বিঘা জমিতে মাল্টা, লেবু আর পেয়ারার বাগান গড়তে উদ্যোগী হয়েছেন জাহিদ।
তামাট গ্রামের বহু মানুষের কাছেই জাহিদ পরিবর্তনের রূপকার। অসংখ্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন লেবুবাগান করতে। আমি বলি কৃষিতেই সমৃদ্ধি। তার প্রমাণ মেলে জাহিদের লেবুবাগানে। বাজার আর সময়ের চাহিদাকে পূরণ করার উদ্যোগের মধ্যেই রয়েছে একজন কৃষি উদ্যোক্তার সাফল্য। জাহিদ হাসান শুধু তাঁর নিজের সাফল্য নিশ্চিত করেননি, রীতিমতো লেবু চাষের এক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হবেন দেশের অনেক তরুণ উদ্যোক্তা।
১৪ দিন ১৪ ঘন্টা ৪১ মিনিট আগে
১৮ দিন ৫ ঘন্টা ৩১ মিনিট আগে
২৬ দিন ২০ ঘন্টা ৪৩ মিনিট আগে
২৭ দিন ৯ ঘন্টা ৩৯ মিনিট আগে
২৭ দিন ১০ ঘন্টা ৩২ মিনিট আগে
২৮ দিন ৬ ঘন্টা ৫৬ মিনিট আগে
৩৯ দিন ২ ঘন্টা ৪২ মিনিট আগে
৩৯ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট আগে