◾ মিসবাহুল ইসলাম : বছর ঘুরে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়। কিন্তু ধনীরাই কেবল বড় লোক হয়। গরীবের জীবনে কোন উন্নতি হয় না। মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত এই সমাজ ব্যবস্থারপনার এখন এটাই চরম বাস্তবতা। দিন যতই গড়ায়, লোকে বলে, "কারো পৌষ মাস কারো হয় সর্বনাশ"। বাংলাদেশ এখন মধ্যআয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবেও বেশ উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের গবেষণানুযায়ী, ধনীরা কেবলই ধনী হচ্ছে আর গরিবেরা শুধুই কাতরাচ্ছে। দ্রব্য সামগ্রী কিনতে এবং সংসার চালাতে নাভিশ্বাস ফেলতে হচ্ছে তাদের। গরিব মানুষদের এখন উন্নতি নেই। বড় লোকরাই শুধু লাভবান হয় । অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। তাদের জায়গা জমি এবং সুউচ্চ ভবন সংখ্যা বাড়ছে। শহরে ধনীদের এই সংখ্যা বাড়ার সাথে বাড়ছে দেশে বর্ণবৈষম্য। কেউ না খেয়ে আছে আর কেউ খাবার রাখার জায়গা পাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশ এখন ধনী গরিবের বৈষম্যে পৃথিবীর প্রায় শীর্ষে রয়েছে। একটি সমাজে সাধারণত তিন শ্রেণীর মানুষ বসবাস করে। ১.ধনী ২.মধ্যবিত্ত ৩.গরিব-নিঃস্ব। কিন্তু দেশে এখন ধনী গরীবের যুদ্ধই প্রকট। মধ্যবিত্তরা এখন প্রায় গরিবের কাতারে। দার্শনিক প্লেটো প্রায় সাড়ে চারশত বছর আগে বলেছিলেন, একটা শহর যতই ছোট হোক না কেন তা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত: ১.ধনী ২.গরিব এই দু'পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলবেই। যার চরম বাস্তবতা এখন আমাদের বাংলাদেশ। নিম্ন আয়ের দেশে কোটিপতি এই বৈষম্য এখন বাড়ছে। বৈষম্যের এই চিত্র খুবই বিস্ময়কর। স্বপ্নের মত অনেকেই বাস্তব জীবনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। ধনী হতে বেশি সময় লাগছে না। ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশে ১০০ টাকা আয়ের ২৮.৪ টাকা ছিল ধনীদের হাতে আর ২০২২ সালে তা বেড়েছে ৪০.৯০টাকা। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের জরিপ অনুযায়ী দেশের ১০% ধনী মোট আয়ের ২৮. ৪ শতাংশ ছিল আয়। পরবর্তী ১৫ বছরে বেশি একটা পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ১৯৮৮- ৮৯ অর্থবছরের জরিপে দেখা যায় ১০ শতাংশ ধনীদের কিছুটা আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১শতাংশ। আর ২০১০ সাল নাগাদ মোট আয়ের প্রায় ৩০% এসে দাঁড়িয়েছে ধনীদের হাতে। স্বাধীনতার পর থেকে গরিব মানুষদের আয়ের অংশীদারিত্ব এখনকার থেকে ভালো ছিল। কিন্তু আয় ব্যয়ের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এরপর আরো খারাপ হতে থাকে। ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় কমে মোট ১দশমিক ৩১শতাংশ হয়েছে। সব মিলিয়ে এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ আয় হচ্ছে ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে। আর বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের মোট আয় হচ্ছে এক ভাগ। তাই অর্থনীতিবিদদের হিসেব অনুযায়ী দেশে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন হাজার ডলারের কাছাকাছি। ২০১৫ সালে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ । জাতিসংঘের হিসেবে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হবে ২০২৬ সালের পর। তাই দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়লেও হচ্ছে না সুষম বন্টন। বৈধ অবৈধভাবে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ধনী এক শ্রেণীর মানুষ। অথচ অসংখ্য মানুষ আমরা দেখেছি করোনা মহামারিতে কর্মসংস্থান হারিয়েছে, অসুস্থ হয়েছে, শিক্ষায় পিছিয়ে গেছে, তাই দেশে গরিবের সংখ্যা এখন আরও বেড়ে গেছে কিন্তু ধনীরা দেশে গরীবদের সহায়তা করে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজে অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়ে অসীম ভূমিকা রাখার সামর্থ্য রাখে এই ধনাট্যরা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির বিরাট নির্ভরতা এখন কিছু ধনীদের হাতে। বিদ্যমান বাজার অর্থনীতিতে ধনী গরিবের বৈষম্য চরমভাবে বাড়ছে। কিন্তু বৈষম্য নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। একসময় এই বৈষম্যই দেশের জন্য বড় হুমকির কারণ হতে পারে তা নিয়ে আমাদের ভাবনা নেই। এজন্য ধনী গরীবের বৈষম্য দূর করতে সমাজে ধনীদের ব্যাপক ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরেই বৈষম্য একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে রয়েছে। ধনী গরিবের মাঝে এই বিভাজন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে দিয়েছে। বৈষম্যের নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন: সম্পদকে নিজস্ব কেন্দ্রীয়করণের মাধ্যমে এটা হতে পারে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ধনীদের হাতে ছেড়ে দিলে তারা অসীম অর্থ জমা করার সুযোগ পায়। তাদের থেকে সম্পদ জন্ম নেয়। সেই সম্পদ তাদের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে তাদের নিয়ন্ত্রণে তা ঘোরাফেরা করে।সকলের অগোচরে তা আরো বাড়তে থাকে। এই পদ্ধতিতে তারা ধনী থেকে আরো ধনী হয় ফলে সমাজের বিশাল এক অংশ তাদের অধীনে চলে যায়। এভাবেই বৈষম্যের বিস্তার ঘটে। অর্থনৈতিক অনিয়মেও বৈষম্য হতে পারে। দরিদ্ররা যখন তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করতে চায় এবং অর্থনৈতিক বাজারে ডলারের দাম যখন বৃদ্ধি পায় তখন দ্রব্য সামগ্রীর দাম উর্ধ্ব হয়ে যায় । গরীবদের টাকা বড় বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটরা হাতিয়া নেয়। দরিদ্রদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে ধনীদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের কারণে বৈষম্য বাড়তে থাকে। এর প্রভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা চরমভাবে বাধাগ্রস্থের শিকার হয়। বিনিয়োগ উদ্ভাবন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিরাট বাধা তৈরি হয় এতে। এবং সমাজের পূর্ণ সম্ভাবনা বাধার সম্মুখীন হয় । তাই অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হওয়ার বিশাল এই চক্র "বৈষম্য" দূর করা খুবই জরুরী। স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্যও বিরাট হুমকি এই বৈষম্য। দরিদ্র ব্যক্তিরা মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা, পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং নিরাপদ জীবন যাত্রার হীনতায় ভোগে। ফলে সাধারণভাবেই দরিদ্র এবং অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে তা স্থায়ী হতে থাকে। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করার জন্য অনেকেই নানা ভাবনা ভাবছেন। তাই ধনীরা তাদের ন্যায্য অংশ বুঝে নিবে। গরিবদের জন্য তাদের অর্থ থেকে কর হিসেবে একটা অংশ গরীবদের জন্য বরাদ্দ রাখবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যেন তারা গরিবদের অধিকার বঞ্চিত করতে না পারে। শ্রম অধিকার শক্তিশালী করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান করে বৈষম্য দূর করার জন্য বিরাট ভূমিকা হতে পারে। তাই ন্যূনতম মজুরির আইন প্রয়োগ করা জরুরী। সব শ্রেনীর শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু চরম পরিতাপ ও আফসোসের বিষয় হলো, দেশে শ্রমিকদের ন্যায্য মূল্যায়ন নিশ্চিত হচ্ছে না। অথচ দেশের উন্নতি এবং অগ্রগতির বিশাল এক নির্ভরশীলতা তাদের শ্রমের উপর। একটি টেকসই ও উন্নত সমাজ গঠনের জন্য ধনী ও গরিবের বৈষম্য দূর করা খুবই জরুরী। বৈষম্যের কারণগুলো তাই দূর করতে হবে। দেশের সরকার সকল প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত ও সমন্বিত সকলের উদ্যোগে বৈষম্য দূর করার জন্য এগিয়ে আসা জরুরী। এক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার, দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ফলে যাদের আয়কম এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে তাদের আয় বাড়বে। সুবিধা বঞ্চিত চাকরির অভাব দূর হবে । ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। যদিও ব্যাংকিংয়ের সেবা দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান এই ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও খুব প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে বড় হাতিয়ার হতে পারে এটা। মনে রাখা দরকার কোন এক পদ্ধতিতে ধনী ও দরিদ্রদের এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব না তাই সকলের সহযোগিতায় এই বৈষম্য দূর করার লাগাম টেনে ধরা জরুরী।
লেখক,মিসবাহুল ইসলাম
শিক্ষার্থী,
বিভাগ : উচ্চতর ইসলামীক আইন গবেষণা, ঢাকা
৭ ঘন্টা ২৯ মিনিট আগে
৫ দিন ৫ ঘন্টা ৮ মিনিট আগে
১০ দিন ২২ ঘন্টা ৫৪ মিনিট আগে
১১ দিন ১৫ ঘন্টা ৫৪ মিনিট আগে
১১ দিন ১৭ ঘন্টা ৫৫ মিনিট আগে
১২ দিন ৩ ঘন্টা ৩০ মিনিট আগে
১৩ দিন ১ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
১৩ দিন ১৫ ঘন্টা ৫০ মিনিট আগে