◾সৈয়দ মোঃ জাহেদুল ইসলাম
ব্যক্তিজীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত যেমন পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়, ঠিক তেমনই কল্যাণকামী যেকোনো রাষ্ট্রের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমুহের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যশীল আচরণ, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাশিয়ার সামরিক শক্তি বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সূত্রপাত করতে যাচ্ছে। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে ছাঁচে ফেলে পুনঃস্থাপনের এই সময় বৈশ্বিক রাজনীতিকে নিয়ে আসবে পালাবদলের বিশাল চক্রে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উত্থান হওয়া যুক্তরাষ্ট্র সুদীর্ঘকাল ধরে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে বিশ্বের পরাশক্তি হওয়ার দৌড়ে বর্তমানে পিছিয়ে নেই চীন, রাশিয়া কিংবা কোরিয়াও। বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট গঠন করে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে সমৃদ্ধ করছে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো। তেমনই কিছু আঞ্চলিক জোটের মধ্যে রয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান ন্যাশান (আসিয়ান), রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি), ইন্দো প্যাসিফিক ইকনোমিক ফোরাম (আইপিইএফ), কোয়াড্রি ল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ (কোয়াড), আইটুইউটু ইত্যাদি। এসকল আঞ্চলিক জোট যতটা না বাণিজ্যিক স্বার্থে গঠিত, তারচেয়ে অনেকবেশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত।
বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদ এবং বাণিজ্যের বিশাল বাজার দিয়ে বিশ্বরাজনীতির অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে এশিয়া। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবাপন্ন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য, অন্যদিকে চীন ও ভারতের আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার প্রচেষ্টা এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে। এই পরিস্থিতিতে কোনো আঞ্চলিক জোটে যোগদান কিংবা সমর্থনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক কি হবে তা নিয়ে আদৌ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। এর পেছনে বেশকিছু অনুঘটক দায়ী, যার মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক স্বার্থ, অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা উল্লেখযোগ্য। বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা প্রতিনিয়ত মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বললেও, আদতে এর কোনো বাস্তব প্রয়োগ করা হয়না। চাইলেই কোনো রাষ্ট্র সর্বোত্তম বাণিজ্য সুবিধার জন্য তার পছন্দের কোনো রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনা। জাতীয় নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় ইচ্ছা হলেই কেউ আঞ্চলিক কোনো জোটের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনা, যার বাস্তব উদাহরণ ইউক্রেনের দিকে তাকালেই পাওয়া যায়। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের স্বাধীনতায় পূর্ণ সামরিক শক্তি দিয়ে হস্তক্ষেপ করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনে ন্যাটো জোটের সামরিক উপস্থিতি রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে বলে মস্কো প্রশাসন পূর্ণ শক্তির প্রয়োগ করে তার মোকাবিলা করে যাচ্ছে।
এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তারের জন্য একদিকে রয়েছে চীনের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক জোট আরসিইপি এবং অন্যদিকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন বাণিজ্যিক জোট আইপিইএফ। এরমধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর আরসিইপি এবং আইপিইএফ উভয় জোটের সদস্য। অন্যদিকে দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরের জলসীমা নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে গণচীনের সাথে দ্বন্দ্ব চলছে জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই ও তাইওয়ানের। এদিকে ফিলিপাইন, ব্রুনাই ও ভিয়েতনাম চীনের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক জোট আরসিইপি'র সদস্যরাষ্ট্র। জোটের সদস্যদের সাথে গণচীনের চলমান এই দ্বন্ধ থেকে পূর্ণ সুবিধা নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এরজন্য ওয়াশিংটন থেকে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার অবসান করে তাদেরকে বিপুল পরিমাণে সামরিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। অন্যদিকে বেইজিং সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে জল ও স্থল সীমাকে ব্যাপকভাবে সামরিকায়ন করেছে। এর ফলে সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সন্দেহের উদ্বেগ হচ্ছে, যা পরবর্তীতে সংঘাতে রূপ নিতে পারে। পাশাপাশি এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রে সরাসরি বিনিয়োগ করে তাদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নে সহায়তা করছে গণচীন।
এক্ষেত্রে আলোচনায় আসতে পারে ভারত, যা গণচীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। চীনের সাথে লাদাখ সীমান্ত নিয়ে ভারতের ঐতিহাসিক বিরোধ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা আদৌ ক্ষীণ, যার পূর্ণ সুযোগ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ভারত, ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নিয়ে আইটুইউটু জোট গঠন করা হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য যতটা না বাণিজ্যিক, তারচেয়ে অনেকবেশি রাজনৈতিক বলা যায়। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য এই আঞ্চলিক জোট গঠন করা হলেও মূলত একে গণচীন বিরোধী একটি শক্তি হিসেবে উল্লেখ করছে রাজনীতি বিশ্লেষকরা। ইতিপূর্বে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে চীনের উত্থান রোধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়াড গঠন করা হয়েছে, যার সদস্যরাষ্ট্র ছিলো ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। ভারত আঞ্চলিকভাবে আধিপত্যশীল শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অভিপ্রায়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক সমৃদ্ধির জন্য এসকল জোটভুক্ত রাষ্ট্রের পূর্ণ সহযোগিতা নিচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ও মায়ানমার তাদের জাতীয় সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে চীনের সহযোগিতা পেয়ে আসছে। মূলত এশিয়ার এসকল অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ও আধিপত্য স্থাপনের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে, আদৌ কোনো জোটের আওতাভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কিংবা প্রয়োজন আছে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছেনা। তবে সবকিছুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার জাতীয় নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিবে বলে মনে করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটো খাত তৈরি পোশাকশিল্প এবং র্যামিটেন্সের উপর এসকল আঞ্চলিক জোটের কোনো প্রভাব থাকলে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে এর আওতামুক্ত থাকতে চাইবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন আইপিইএফ এর বিষয়ে ইতিমধ্যেই বিবৃতিতে জানানো হয় সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সাপ্লাই চেইন, জ্বালানি ও বাণিজ্য করের ক্ষেত্রে সরাসরি তদারকি করা হবে। তৈরি পোশাক ও র্যামিটেন্স থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বৃহৎ অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। অন্যদিকে পণ্য আমদানি এবং উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে বৃহৎ ঋণের ক্ষেত্রে চীন আমাদের পূর্ণ সহায়তা দিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা বিবেচনা করা যেমন গুরুত্ববহ, রাজনৈতিক সমীকরণে নিজেদের অবস্থান যাচাই করাও তেমন জরুরি। অর্থনীতির ভাষায় একে সুযোগ ব্যয় বলে অভিহিত করা হয়, যেখানে কোনো একটি সুবিধার বিপরীতে অন্যকোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে হয়। সুতরাং, জনগণের স্বার্থরক্ষা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ, প্রান্তিক কৃষির সম্প্রসারণ, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সুদূরপ্রসারী কোনো সিদ্ধান্ত নিবে বলে আশা করা যায়। অস্ত্রের অবাদ বাণিজ্য তথা সামরিক মহড়া বন্ধ হোক, আধিপত্য এবং স্বার্থকে ঘিরে চলমান দ্বন্ধ, সংঘাত ও নৈরাজ্যের উর্ধ্বে গিয়ে পৃথিবীটা মানুষের হোক।
• লেখক:
সৈয়দ মোঃ জাহেদুল ইসলাম
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
গবেষণা সহকারী, ব্র্যাক জেপিজি স্কুল অব পাবলিক হেলথ্, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
২ দিন ১০ ঘন্টা ৮ মিনিট আগে
৮ দিন ৪ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে
৯ দিন ৪ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে
১৩ দিন ১৩ ঘন্টা ৫৯ মিনিট আগে
১৫ দিন ২২ ঘন্টা ১ মিনিট আগে
২২ দিন ৯ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আগে
২৩ দিন ২ ঘন্টা ৫৬ মিনিট আগে
২৪ দিন ২৮ মিনিট আগে