মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন
একজন আলেমের বিদায় মানে একটি নক্ষত্রের বিদায় এবং মুসলিম জাতি অভিভাবকহারা হওয়া৷ হাদীসের ভাষায়, "আলেমের মৃত্যু মানে একটি জাহানের মৃত্যু"। আল্লাহ তায়ালা ইলম বা দ্বীনকে উঠিয়ে নিবেন আলেমগণকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে।"
ইতিহাসে এমন অনেক লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, পৃথিবী থেকে চলে গেলেও এখনো তাঁরা জীবিত। কেবল নামই নয়, বরং নামের সাথে তাদের চরিত্র ও গুণাবলীরও ফুঠে উঠে।সেসব স্বরণীয় ব্যক্তিদের অন্যতম হলেন প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফের পীর শাহ সুফি আল্লামা কুতুব উদ্দিন (রহ:)। ৯ মার্চ ১৯৩৯ সালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের সুফি মিয়াজীপাড়া গ্রামে জন্ম তাঁর।এই আলেমে দ্বীন একজন বিশিষ্ট সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারের অন্যতম পুরোধা, শরীয়ত বিরোধী ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ উচ্ছেদ আন্দোলনের আপোষহীন প্রবক্তা, সত্যনিষ্ঠা এবং বাতিল মতাবাদের আতংক ছিলেন।এমন কি তিনি একজন সংগঠকও বঠে। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ অসংখ্য মাদরাসা, মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং বায়তুশ শরফ দরবারের পীর সাহেব ছিলেন। তিনি ছিলেন বড় অন্তরের অধিকারী ও মধ্যমপন্থী আলেমে দ্বীন। উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সহৃদয়তার মতো গুণের কারণে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সব মানুষকে আপন করে নেয়ার গুণ তাঁর কাছে বিদ্যমান ছিল । তিনি একজন প্রচার বিমুখ দক্ষ সংগঠক ছিলেন। হানাফী মাযহাবের আলোকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা সঠিক সুন্নী মতাদর্শ প্রচার প্রসার করাই ছিল এই আলেমে দ্বীনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপুল সংখ্যক ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ইসলামী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সহ আরো অনেক কর্মীবাহিনী।
শাহ সুফি আল্লামা কুতুব উদ্দিন (রহ:) একজন সফল আরবীবিদ, শিক্ষাবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, উসুল, আরবী, উর্দু ও ফার্সি ইত্যাদি ইসলামী শিক্ষায় অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি আমৃত্যু পর্যন্ত শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে গেছেন। আমাদের দেশে এমন অনেক খতীব ও বক্তা আছেন যারা কুরআন-হাদীসের আলোকে হিদায়ত করেন না। ওয়াজ নসীহত করেন না, বরং মনগড়া কিস্সাকাহিনী, অর্থহীন মূল্যহীন বানোয়াট ঘটনাসমূহ বর্ণনা করেন। শ্রোতাদের মন জয় করার হীনপ্রচেষ্টা চালান। আর তারা এ ওয়াজকে আয়ের উৎস হিসেবে মনে করেন। একই সাথে ভিন্নধর্মী আলেমদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে থাকেন। সেদিক দিয়ে শাহ সুফি আল্লামা কুতুব উদ্দিন (রহ:) ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁর ওয়াজ-নসীহতের উছিলায় হাজার হাজার বিভ্রান্ত লোক পথের দিশা পেয়েছে। তার বক্তব্যে কুরআন-হাদীসের পাশাপাশি ফিকহের মাসয়ালাসমূহ ছাড়াও উর্দু-ফার্সী কবিতার অপূর্ব সমাহার ছিল। তিনি মানবজীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগের উপর ইসলামী দৃষ্টিকোণ তাদের নিকট তুলে ধরতেন। তাঁর ওয়াজের মধ্যে এমন মূল্যবান মাসয়ালা বর্ণিত হতো যা দ্বীনে প্রয়োজনীয়তার সহিত সম্পৃক্ত ছিল।
এই আলেমে দ্বীনের সরাসরি সান্নিধ্য যাওয়ার সুযোগ না হলেও তার ওয়াজে কিংবা তাকরীরে বসার অসংখ্যবার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে সুপ্রসিদ্ধ কুতুবে জামান, অলীয়ে কামেল হযরত শাহসূফী হাফেজ আহমদ (রহ.)'র প্রতিষ্ঠিত চুনতীর ঐতিহাসসিক ১৯ দিনব্যাপী সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলে। হুজুর কেবলার ওয়াজ শুনার জন্য শেষ দিবসে মাহফিলের উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতাম। ২০১৬ সালে চুনতীর কাজী নাসিরুদ্দীন সাহেবের মাধ্যমে হুজুরের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। আমার পরিচয় পাওয়ার পর আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং আমার কপালে চুমো দেন। আব্বা হুজুর মরহুম শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ) কে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করেন। এবং তাঁর হাদীস শাস্ত্র সহ অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানের পাণ্ডিত্য অকপটে স্বীকার করেন। একই সাথে ১৯ দিন ব্যাপী সিরাতুন্নবী (সা) মাহফিলের উদ্বোধকের কথা স্বরণ করিয়ে দেন। হুজুর কেবলাকে সিরাতুন্নবী (সা) মাহফিল সহ অন্যান্য মাহফিলে আর দেখা কিংবা শুনা যাবে না। গত ২০ মে ২০২০ সালে বিকেল ৫টায় রাজধানীর আনোয়ার খাঁন মেডিকেলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ডাকে চিরদিনের জন্য সাড়া দেন। বৃহস্পতিবার (২১ মে) ফজরের নামাজের পর মরহুমের ছেলে মাওলানা বেলাল উদ্দিনের ইমামতিতে বায়তুশ শরফ দরবারে মসজিদের পাশে মরহুম পীর শাহ সূফী আব্দুল জাব্বার রহ. এর কবরের পাশে দাফন করা হয়। আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আল্লামা মাওলানা কুতুব উদ্দিন (রহ.) ছিলেন আলেম সমাজের মধ্যে অতুলনীয় ও প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব।দ্বীনের খেদমত ও তরিকতে তার বহুমুখী অবদান ও ত্যাগ অবিস্বরণীয়।ইসলামের সঠিক ও মূলধারাকে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আজীবন প্রয়াস চালিয়েছেন। ইতিহাসে তিনি অস্লান ও বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।তিনি এমন একজন মানুষ , যাঁর জ্ঞানের পরিধি সুবিস্তৃত ও সুবিশাল। তাই তিনি ধর্মীয় মহলে ‘বাহরুল উলুম’ (জ্ঞানের সাগর) নামে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। শিক্ষক সমাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্র সমাজের কাছে একজন প্রাণপ্রিয় মান্যবর উস্তাদ।আর সাধারণ জনগণের কাছে সম্মানিত, মান্যগণ্য ব্যক্তিত্ব।আসুন আমরা এই মহান আলেমের অনুপম চারিত্রিক ও আদর্শ অনুসরণ করে দ্বীনের খেদমতে নিজেদের নিয়োজিত করি।
লেখক: কলামিস্ট।
প্রচার ও প্রকাশনা সচিব, বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতি।
২ দিন ১ ঘন্টা ৩৭ মিনিট আগে
২ দিন ১ ঘন্টা ৪৩ মিনিট আগে
৬ দিন ৫৭ মিনিট আগে
৬ দিন ৮ ঘন্টা ৪১ মিনিট আগে
৭ দিন ১৮ ঘন্টা ৪৭ মিনিট আগে
৮ দিন ৫ ঘন্টা ৩৬ মিনিট আগে
৯ দিন ২৩ ঘন্টা ২০ মিনিট আগে
১০ দিন ১০ ঘন্টা ২৫ মিনিট আগে