বল বীর—বল উন্নত মম শির ! শির নেহারি আমারি, নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির।
এই অগ্নিঝরা পঙ্ক্তিগুলো শুনলেই প্রতিটি হৃদয়ে জেগে ওঠে দুর্দম সাহস ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াবার এক অদম্য মনোবল। এই পঙ্ক্তিগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই বিদ্রোহী সত্ত্বাকে, যিনি কেবল কলমের জোরেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সব অন্যায়, শঠতা, ও পাপাচারের বিরুদ্ধে। যিনি বাংলা সাহিত্যকে আঠারো শতকের রবীন্দ্র বলয়ের গ্রাস থেকে মুক্ত করে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। মুসলিম লেখকদের মাঝে নব প্রাণের সঞ্চার করে ধরিয়েছেন বহ্নি শিখা।
তিনি হলেন আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি—কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কলম ছিল বজ্রকঠিন, যা গর্জে উঠত নির্যাতিত, নিপীড়িত, ও অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ে।
বাংলার মাটি ও মানুষ যখন বৃটিশদের শাসন শোষণে জর্জরিত। আকাশে বাতাসে যখন কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে, সর্বত্র যখন বৃটিশদের স্টিমরোলারে মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ তখন বাংলা সাহিত্যে আগুনের ঝান্ডা হাতে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব।
২৫ শে মে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তার জন্মদিন। ১৮৯৯ সালের ২৫ মে(১১জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমায় চুরুলিয়া গ্রামে এই মহান কবির জন্ম। শৈশব থেকে শুরু করে তার পুরো জীবন কাটে নানা বৈচিত্র্যের মাঝে। বাবা কাজী ফকির আহমেদ মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। গ্রামের মক্তব থেকে শিক্ষা জীবন শুরু হতেই মাত্র নয় বছর বয়সে বাবা মারা যায়। জীবনে নেমে আসে কঠিন বিপর্যয়। লেটোর দলে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে রুটির দোকানের কারিগর ও হয়েছেন। ভাগ্যের সন্ধানে ময়মনসিংহের ত্রিশালে দারোগা বাবুর সান্নিধ্যে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা হয় তাঁর।
ইসলামের শিক্ষার দিকে ছিলেন বেশ এগিয়ে। হয়েছিলেন মসজিদের ময়াজ্জিন। আবার বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে ও জ্ঞান আহরণের পিপাসা তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। আরবি, ফার্সি,উর্দু একাধিক ভাষায় রয়েছে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ১ম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শুধু একজন সৈনিক নন তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান কবি,সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক,প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্যের লীলাভূমিতে তার কালজয়ী লেখাগুলোর মধ্যে 'বিদ্রোহী' কবিতা অন্যতম।তিনি ছিলেন বিদ্রোহী এক আত্মা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার লেখা হয়ে ওঠেছিল এক অনন্য বজ্রকন্ঠ। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা,বৈষম্য ও শোষনের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছুটে চলছিল নির্ভয়ে দুর্বার গতিতে। ১৯২২ সালে যখন তার কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নিবীণা' প্রকাশিত হয় তখন তিনি ছিলেন টগবগে যুবক। প্রতিটি লেখায় তার বিষ্ময়কর মহিমান্বিত এক অবিনাশী প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ।
সংগীত জগতে ছিল তাঁর বড় অবদান। প্রায় ৪০০০ গানের স্রষ্টা তিনি। যেগুলো 'নজরুলগীতি' নামে পরিচিত। দেশাত্মবোধক গান,জাগরণী,ইসলামি গান,গজল,শ্যামা সংগীত ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালির হৃদয়ে বৈচিত্র্য ও নতনত্বের ধারায় নবপ্রাণ সঞ্চারিত করছেন। প্রেম, দেশপ্রেম, মানবতা,ও ইসলামি ভাবনা কে ঘিরে তার সংগীত বাঙালির হৃদয়কো আজও অনুরণিত করে।
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হচ্ছে–
কাব্যগ্রন্থ: অগ্নিবীণা, ফনিমনসা,ছায়ানট সন্ধ্যা,চক্রবাক,দোলনচাঁপা, সাম্যবাদী,বিষের বাঁশি, প্রলয়শিখা,ভাঙার গান,জিঞ্জির, সর্বহারা, ঝিঙেফুল,ইত্যাদি।
উপন্যাস: মৃত্যুক্ষুধা,বাঁধনহারা,কুহেলিকা
ছোটগল্প: রিক্তের বেদনা, হেনা,অতলস্পর্শ, সঞ্চিতা,রূদ্রমঙ্গল, নতুন চাঁদ,মরুভাস্কর,ইত্যাদি।
নাটক:ঝিলিমিলি, মধুমালা,আলেয়া পুতুলের বিয়ে ইত্যাদি।
এছাড়াও রাজবন্দীর জবানবন্দি, যুগবাণী ইত্যাদি প্রবন্ধ এবং অনুবাদগ্রন্থ ও লিখেছেন।
তাঁর কবিতা গান বাংলাভাষী পাঠকের মধ্যে তুঙ্গস্পর্শী।মাত্র ২৪ বছরের লেখালেখির জীবনে বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় পদচারণা দিয়ে গেছেন। সম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহী কবিতা লিখে কারাবরণ করেছেন। ব্রিটিশদের বলেছেন - 'এক পরমাণু অংশও ব্রিটিশদের অধীনে থাকব না'। এজন্য অনেক গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তার লেখার প্রতিটি লাইনের শব্দ ছিল শিকল ভাঙার বারুদ। আর প্রেম মহিমায় ছিল অত্যন্ত কোমলতা।
তিনি ছিলেন মানবতার কবি। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, সাম্য ও ভালোবাসার কথা তিনি বারবার বলেছেন। তাঁর এই চেতনাই পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ব্রিটিশ আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫২ ভাষা আন্দোলন ১৯৭১ 'র মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সকল আন্দোলন তার লেখা কবিতা গান বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। বাংলা সাহিত্য অবধানের জন্য বেশ কয়েকটি সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
১৯৪২ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘদিন নীরব জীবন যাপন করার পর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট(১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে তিনি আজো আমাদের চেতনার বাতিঘর।
নজরুল শুধু একজন কবি নন, তিনি আমাদের অন্তরে জেগে থাকা বিদ্রোহ, প্রেম ও মুক্তির প্রতীক। তাঁর জন্মদিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এই মহান পুরুষকে, যিনি আমাদের শিখিয়েছেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।
সজিব হোসেন
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা কলেজ
৯ ঘন্টা ১ মিনিট আগে
১২ ঘন্টা ১ মিনিট আগে
১২ ঘন্টা ৫৬ মিনিট আগে
১৩ ঘন্টা ২ মিনিট আগে
১৪ ঘন্টা ৪৮ মিনিট আগে
১ দিন ১ ঘন্টা ৩ মিনিট আগে
১ দিন ৩ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আগে
১ দিন ৪ ঘন্টা ৭ মিনিট আগে