রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে আইডিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের গাফিলতিতে চার মাসের বেতন বন্ধ শিক্ষক ও কর্মচারীদের।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ আইডিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফকির আব্দুল কাদেরের স্বেচ্ছাচারিতার কারনে ওই প্রতিষ্ঠানের ২৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী গত জুলাই মাস থেকে ৪ মাস বেতন বঞ্চিত রয়েছেন। বেতন ছাড় করতে তিনি এক মাসের সমপরিমান প্রায় ৬ লক্ষ টাকা দাবি করেছেন শিক্ষক-কর্মচারিদের কাছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চেয়ে ২০ নভেম্বর গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, এমপিও ভুক্ত গোয়ালন্দ আইডিয়াল হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল জব্বার শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে গত জুলাই মাসের ৬ তারিখে পদত্যাগ করেন। এর ফলে ওই বিদ্যালয়ের সাধারন ও ভোকেশনার শাখার সর্বমোট ২৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৪ মাসের সরকারী অংশের বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করতে পারছেন না। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।
এ বিষয়ে শিক্ষকরা গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পারেন সভাপতির পদত্যাগ পত্রটি শিক্ষাবোর্ডে গৃহীত হয়নি। কাজেই পূর্বের কমিটিই বহাল রয়েছে।
এ অবস্হায় তারা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে বেতন-ভাতার বিলে স্বাক্ষর করার অনুরোধ করলে তিনি সভা ডেকে সকল শিক্ষক-কর্মচারীর কাছে ১ মাসের বেতনের টাকা (প্রায় ৬ লক্ষ) দাবি করেন। এরপর তিনি বেতন বিলে স্বাক্ষর করবেন বলে প্রস্তাব করেন।
কিন্তু এ প্রস্তাবে তারা অস্বীকৃতি জানালে প্রধান শিক্ষক ফকীর আব্দুল কাদের বেতন-ভাতার বিলে স্বাক্ষর না করে বিভিন্ন ধরনের তালবাহানা শুরু করেন।
এদিকে নভেম্বর মাসের ১৬ তারিখে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভায় সভাপতি ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রধান শিক্ষককে বারবার অনুরোধ করেন এবং সর্বশেষ নির্দেশ দেওয়া সত্বেও সে বেতন-ভাতাদি বিলে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়।
এ দিকে বুধবার সরেজমিন ওই বিদ্যালয়ে গেলে শিক্ষক - কর্মচারিরা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অসদারন, জাত-পাত তুলে গালিগালাজ,গায়ে হাত তোলা,নিয়োগ বানিজ্য, বিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের সমুদয় অর্থ নয়ছয় করা, তার আচরনে সভাপতির পদত্যাগ করা সহ নানা ধরনের তোলেন।
বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সাধন কুমার সাহা বলেন, তিনি বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত। কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসকের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ খেতে পারছেন না। সংসারের অন্যান্য মৌলিক চাহিদাও মেটাতে পারছেন না। বাজারের দোকানদাররা আর বাকি দিতে চাচ্ছেন না। মনোকষ্টে যে কোন সময় হয়তো স্ট্রোক করে মারা যেতে পারেন।
তাছাড়া যেনতেন কারনে প্রধান শিক্ষক তাদের সাথে দুর্ব্যবহার ও জাত-পাত তুলে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেন। গায়ে হাত তোলেন।তার দূর্ব্যবহারের কারনে আমি কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি নিঃসন্তান বলে অসহায় স্ত্রীর কথা ভেবে আত্মহত্যাও করতে পারিনি।
সহকারী শিক্ষক দীপক কুমার বলেন, তার তিনটি ছেলেমেয়ে কলেজ-বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। গত ৪ মাস ধরে আমি তাদের ভরন-পোষনসহ লেখাপড়ার ব্যায় মেটাতে পারছি না।
এ নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি আমাদের মালাউনের বাচ্চা,নাপিতের বাচ্চা,চামারের বাচ্চা,মুচির বাচ্চা প্রভৃতি বলে গালিগালাজ করেন। একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে তখন বড্ড অপরাধী মনে হয়।
মোঃ আব্দুল্লাহ নামের ধর্মীয় শিক্ষক আবেগী কন্ঠে বলেন, শিক্ষকতা ছাড়া তার আর কোন আয়ের পথ নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতরভাবে বেঁচে আছেন। ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে গেছেন। গত ৪ টা মাস স্ত্রী-সন্তানদের সামনে একটু মাস মাংস কিনতে পারেননি। এই কষ্ট মেনে নিতে পারছি না।
দীপালী রায় নামের এক শিক্ষক জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনই এই স্কুলে কর্মরত। তাদের বড় ছেলেটা রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) পড়ালেখা করছে। কিন্তু আমাদের বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের পাশাপাশি আমাদের মেধাবী ছেলেটাও নানা দূর্ভোগের শিকার হচ্ছে। যে করনে নিরুপায় হয়ে আমরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের ন্যায্য সমুদয় বেতনাদি চাই।
এ বিষয়ে গোয়ালন্দ আইডিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফকীর আব্দুল কাদেরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর ক্ষিপ্ত হয়ে যান। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলেন, " দৌলতদিয়া ঘাটসহ সারাদেশে এত দূর্ণিতি হয় সেগুলো চোখে দ্যাখেন না,শুধু আমারটাই দেখলেন, বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন"।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, শিক্ষক-কর্মচারীরা ৫ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না বিষয়টা খুবই দুঃখজনক। অভিযোগের ভিত্তিতে উজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে ও সমাজসেবা কর্মকর্তাকে তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিতে দায়িত্ত্ব দিয়েছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ঢাকায় আছেন। উনি আসলে তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেন, আমি শিক্ষকদের বেতন না পাওয়ার বিষয়টি মৌখিকভাবে শুনেই শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে নিশ্চিত করেন আইডিয়াল হাইস্কুলের সভাপতির পদত্যাগপত্রটি গৃহীত হয়নি। তিনি স্বপদে বহাল আছেন এবং বেতন বিলে স্বাক্ষর করতে পারবেন। আমি এ বিষয়টি সভাপতিকে জানানোর পর তিনি বেতন বিলে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু প্রধান প্রধান শিক্ষক করেন না।
শিক্ষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ আইডিয়াল হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকীর আব্দুল জব্বার বলেন, প্রধান শিক্ষকের সাথে আমার কথা হয়েছে ও ঢাকায় আছে, ফিরলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ।