গোবিন্দপুর নামের একটি ছোট শহরে ছিল টগর নামের একজন চাঁদাবাজ, লুট-পাটকারী, দখলদার ও সন্ত্রাসীর বাস।টগর ছোটবেলায় অতি-দরিদ্রতার কারণে টোকাই ছিল।টগরের পড়ালেখা করা হয়নি এবং সে ছোটবেলা থেকেই উচ্ছৃঙ্খল ও অবাধ্য ছিল। তার এই উচ্ছৃঙ্খলতা একটি রাজনৈতিক দলের এক নেতার চোখে পড়ে এবং রাজনৈতিক লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। টগরকে লাঠিয়াল হিসেবে রাজনীতিতে আনা হলে টোকাই জীবন বাদ দিয়ে টগর ও তার ভাইরা তাদের লিডারের নির্দেশে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধ করতে থাকে। সেই রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে টগর ও তার ভাইরা সেই রাজনৈতিক দলটির শহর শাখাতে আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। ফলে সেই রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসলে চাঁদাবাজি, জমি-দখল, সরকারী অফিসের জিনিস-পত্র লুট, জনগণের মাল-আত্মসাৎ, খুন, ধর্ষণ, জুলুমসহ নানাধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে বেড়ায়। টগরকে আশ্রয়- প্রশ্রয় দেয়া সেই লিডারের মৃত্যুর আগে তার ভাতিজাকে নেতা বানিয়ে যায়, ফলে টগরও তার লিডারের ভাতিজার লাঠিয়াল হিসেবে কাজ শুরু করে। ফলে টগর তার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসলে বাধাঁবিহীনভাবে অপর্কম করতে থাকে।টিগর ছিল অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও নিচুমনের মানুষ। টগর ধনী হওয়ার জন্য তার মেয়েদের দিয়ে দেহব্যবসা চালাতো ও মাদকের ব্যবসা করতো। টগরের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পর সে শহরের মধ্যে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। চারদিকে লুটপাট, চাঁদাবাজি, জমিদখল,ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ,খুন,ধর্ষণসহ নানা অপরাধ করতে থাকে।
টগরের এক মেয়েকে সে একটি বেসরকারী স্কুলে ভর্তি করায়। তার সেই মেয়ের নাম ছিল লামিয়া। লামিয়া ছিল অত্যন্ত কুৎসিৎ দেখতে, অনেকটা আফ্রিকান নিগ্রোদের মতো। কিন্তু, সে এতো পরিমাণ ক্রিম আর মেকাপ করতো যে,সে যে কালো সেই চিহ্নও রাখতো না। এভাবেই স্কুলের একের পর এক ছেলেকে তার প্রতি পাগল বানাতে থাকে, সেই মেয়েটি। কয়েকদিন পর- পরই প্রেমের প্রস্তাব পেয়ে ঝুঁলিয়ে রাখতো সেই মেয়েটি। অথচ, ওই মেয়ের ক্লাশে পড়া অনেক সুন্দর মেয়েও এতো প্রস্তাব পেতোনা। লামিয়া নামের সেই মেয়েটির পিছনে সবসময়ই ছেলেরা ঘুরতো। একদিন মীর সৌদ নামের এক ছেলে লামিয়াকে গোপনে প্রেমের প্রস্তাব দিলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে আরেকটু বড় হয়ে করবে বলে ঝুঁলিয়ে রাখে। মূলত, স্কুলে ইতিমধ্যে একজনের সাথে প্রেম করার কারণে একসাথে একজায়গায় সমস্যা হবে, এই আশঙ্কা থেকেই ঝুঁলিয়ে রাখে। মীর সৌদ এর মতো নিয়মিতভাবেই কোনো না কোনো ছেলে লামিয়াকে প্রেমের প্রস্তাব দিতো। লামিয়ার বাসার পাশে, স্কুলে, নানাবাড়িসহ তার যাতায়াতের সব জায়গায় একজন করে প্রেমিক ছিল। একটি মেয়ে একসাথে এতোজন ছেলেকে পুতুলের মতো নাচাচ্ছে শুধুমাত্র তাঁর রুপ প্রতারণার দ্ধারা। এজন্যই একটি প্রবাদ রয়েছে, "যদি একটি জাতিকে অস্ত্র ছাড়াই ধ্বংস করতে চাও, তাহলে সে জাতিকে নারী ও মাদকের নেশায় জড়িয়ে দাও।"
লামিয়ার স্কুলের উপরের ক্লাশে পড়া এক ছেলের নাম ছিল ইজরাক। ইজরাক দেখতে অনেক সুদর্শন ছিল। সে মোহনা নামের একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করতো, কিন্তু;মেয়েটি অন্য আরেকজনকে ভালোবাসতো। এজন্য ইজরাক তাকে ভুলে যেতে চাচ্ছিলো। কিন্তুু, কিছুতেই মন থেকে ভুলতে পারছিলনা। ইজরাকের মন থেকে নারী আকাঙ্খা চলে যায় এবং সে সারাজীবন একা থাকতে চায়। কিন্তু, ইজরাক মোহনা নামের যে মেয়েকে পছন্দ করতো, সে তার ভাবনার জগতে বারবার চলে আসতো। এজন্য, ইজরাক নতুন কোনো একটি মেয়েকে প্রতিদিন ভাবতে ভাবতে মনে জায়গা দিয়ে তার সেই ভাবনায় থাকা মোহনাকে পুরোপুরিভাবে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, নতুন একটি মেয়েকে বাছাই করতে গিয়ে ভুল করে ফেলে ইজরাক। সে টগরের মেয়ে লামিয়া নামের সেই মেয়েকে বাছাই করে, প্রতিদিন তাকে নিয়েই ভাবতে থাকে।এভাবেই ইজরাকের লামিয়াকে ভালো লাগতে থাকে। একদিন ইজরাক লামিয়ার সামনে ফুল নিয়ে দাড়ালে, লামিয়া পাশে দিয়ে চলে গিয়ে অফিসে অভিযোগ জানায়। শিক্ষকরা ইজরাককে পরে অফিসে, আসতে বললে শাস্তি হিসেবে প্রহার করা হয়। ইজরাকের বন্ধুরা তাকে বোঝাচ্ছিল, মেয়েটা অনেক খারাপ ও ছলনাময়ী,তোকে মার খাইয়ে আবার কিছুদিন পর প্রেম করতে চাইবে। কিন্তু, ইজরাক আগের মতো এবারও ভুলতে পারছিলনা। কিছুদিন পর লামিয়ার ক্লাশের এক সহপাঠী ইজরাককে এসে বলে, লামিয়া তোমাকেই পছন্দ করে, না জানিয়ে ফুল নিয়ে দাড়াইছিলা তাই বিচার দিছিলো!চিঠি লিখে দিবা আমার মাধ্যমে,নতুন করে প্রেম করার জন্য?!!ইজরাক চুপ ছিল, কিছুই বলেনি। স্কুল জীবন শেষ হওয়ার পর কলেজে ওঠার পর ইজরাক তার বান্ধবী সুমিকে ভালবাসতে শুরু করে। সুমিও তাকে ভালোবাসতো। ইজরাক লামিয়াকে ভুলে গিয়ে নতুন শুরু করলেও লামিয়ার মনে ইজরাকের সুদর্শন দেহের তীব্র আকাঙ্খা জাগে।
লামিয়ার বাবা টগর ইজরাক ও সুমির ভালোবাসা জানতে পেরে সুমিদের বাসায় হামলা চালায়। সুমিকে নানাধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে আসে। যার কারণে সুমি আর কখনোই ইজরাকের সাথে কথা বলেনি। ইজরাকের আশে পাশে সবসময় টগর দালাল রেখে দিতো। কোনো মেয়ে ইজরাকের দিকে তাকালে কিংবা, ইজরাক কোনো মেয়ের দিকে তাকালে সেই মেয়েকে তার পরিবারকে টগর হুমকি-ধামকি দিয়ে আসতো। মেয়েদেরকে হুমকি-ধামকি, ইভটিজিং, ধর্ষণ এসবের অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই টগর চর্চা করেছে। শহরের কেউ টগরের কথামতো কাজ না করলে তার উপর অত্যাচার চালাতো। ইজরাকের একজন চাচাতো বোনের নাম ছিল জারা। জারা ছিল টগরের ভাগ্নী সিজুকার বান্ধবী।ইজরাকদের বাসায় কি হতো, কী বলতো এসব কিছুর তথ্য মোবাইলের মাধ্যমে জারা তার বান্ধবী সিজুকাকে জানিয়ে দিতো এবং সেখান থেকে টগর ও তার মেয়ে লামিয়া জানতে পারতো।ইজরাক টগর ও তার মেয়ে লামিয়াকে প্রচন্ড ঘৃণা করতো। ইজরাকের ঘরের আশে-পাশে টগর প্রতিদিনই সারাক্ষণ দালালদের দিয়ে বিরক্ত করাতো।ইজরাককে কখনোই পড়তে দিতোনা, তার ঘরের আশে-পাশে দালালদের পাঠিয়ে উচ্চস্বরে চিল্লাচিল্লি ও কথা বলাতো। এমনকি ভালোভাবে ঘুমাতেও দিতানা। রাতের বেলা ইজরাকের ঘরের পাশে বক্স বাজানো হতো, উচ্চস্বরে আওয়াজ করতো। মাঝে- মধ্যে পোষা কুকুর রাতের বেলায় ইজরাকের ঘরের সামনে পাঠিয়ে বিরক্ত করতো। ইজরাক তার ভুল বুঝতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু; ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে যায়। ইজরাক সারাদিন যা করতো, বলতো সেই সবকিছু সে রাস্তা দিয়ে চলার সময় টগর জনসাধারনকে ব্যঙ্গ করে বলতে বাধ্য করতো।যেমনঃইজরাক একদিন বললো,আমি ৫০০টাকা দিয়ে একটি পিকনিকে যাব,মা।পাশের বাসা থেকে ইজরাকের চাচাতো বোন জারা সব শুনতে পেয়ে তার বান্ধবী সিজুকাকে জানালে সিজুকা টগরকে জানিয়ে দেয় আর পরদিন জনসাধারণকে ইজরাক রাস্তা দিয়ে চলার সময় সবাইকে ৫০০টাকা পিকনিক বলে ব্যঙ্গ করতে সবাইকে নির্দেশ দেয়।এভাবেই নিয়মিত ব্যঙ্গ করতে থাকে।কেউ টগরের কথামতো কাজ না করলে,তার ওপর জুলুম চালাতো।জুমার দিন যখন মসজিদে যখন খুতবা দেয়া হয়, তখন খতিবরা সব টগরের কথামতো ফতোয়া দিতো। টগর মসজিদের ইমাম বা, খতিবদের তার কথামতো ইজরাক যেন তার মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ফিরে আসে, সেভাবে ফতোয়া দেয়ার জন্য বলে যেতো । খতিব ঠিক সেভাবেই ফতোয়া দিতো। কারণ, টগরের কথামতো কাজ না করলে জুলুমের শিকার হতে পারে আর দালালি করলে হাদিয়া পেতে পারে, এই ভাবনাটাই খতিবের মাথায় ছিল।
এতো পরিমাণ মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ইজরাক মাঝে-মধ্যেই আত্মহত্যা করার কথা ভাবতো। কিন্তুু, পরকালে খারাপ কিছু হবে ভেবে বিরত থাকতো। সে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিয়মিত নিজের মৃত্যু চাইতো, পাশাপাশি, ইজরাক প্রতিদিন টগর ও তার মেয়ে আর দালালদের ধ্বংসের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতো।'৩৬শে জুলাই বিপ্লব' সংঘটিত হলে টগরের মতো টোকাই নেতারা গোবিন্দপুর শহর থেকে পালিয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ নির্যাতিত মজলুম জনতা মৌমাছির মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে টগরের বাড়ি ঢুকে পড়লে টগর স্বপরিবারে পালিয়ে যায়। বাঘের মতো গর্জন নিয়ে নমরুদের মতো ক্ষমতাশালী ভাবা টগর লেজগুটিয়ে ইদুঁরের মতো পালিয়ে যায়। ইজারাক একটা কথাই শুধু ভাবলো, 'শারীরিক অত্যাচারের চেয়ে মানসিক অত্যাচার কতই না ভয়ংকর!!!'
লেখক : মোঃমাহিন ভূঁইয়া
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
শিক্ষার্থী,ঢাকা কলেজ