মোঃ আজগার আলী, সদর উপজেলা প্রতিনিধি সাতক্ষীরাঃ
সাতক্ষীরা সদর-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি সভাপতি হওয়ার পর মাত্র তিন বছরে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে প্রায় ৫ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন চার বছর ধামাচাপা পড়ে রয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও উপেক্ষিত রয়েছে বছরের পর বছর। বর্তমানে কলেজটির সভাপতি এমপির একান্তভাজন মকসুমুল হাকিম।
১৯৮০ সালে সাতক্ষীরায় বেসরকারি কলেজ হিসেবে সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে কলেজটি দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়। তারপরও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেজটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা একসময় ১০ হাজার অতিক্রম করে। এই বিপুল পরিমান শিক্ষার্থীর বেতন, সেশন ফি, উন্নয়ন তহবিলসহ বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা অভ্যন্তরীন আয় হয়। দুর্নীতি অনিয়মের পরেও কলেজটির ব্যাংক একাউন্টে দেড় কোটি টাকা স্থায়ী আমানত জমা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের মার্চে কলেজটির সভাপতি পদে সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে লুটপাটের মহাউৎসব শুরু হয়। শিক্ষক নিয়োগ, এমপিও বানিজ্য এবং আভ্যন্তরীন তহবিল নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। ব্যাংকে থাকা দেড় কোটি টাকার স্থায়ী আমানত ভেঙে ফেলা হয়। তারপরও ননএমপিও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়তে থাকে।
অব্যাহত দুর্নীতি অনিয়ম ও লুটপাটের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৫ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর কলেজটি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে এবং ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ৩২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদনে তিন বছরে কলেজটির প্রায় ২৫টি খাতে ৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকার আভ্যন্তরীন তহবিল আত্মসাতের প্রমান পায়। এছাড়াও ভ্যাট বাবদ ১ লাখ ২৫ হাজার ৯১ টাকা এবং রাজস্ব টিকিট বাবদ ২৮ হাজার ৬০০ টাকা সরকারী কোষাগারে জমা না দিয়ে ফাকি দেওয়ার প্রমান পায়।
তদন্ত প্রতিবেদনে নাশকতা মামলায় পালাতক থাকা উপাধ্যক্ষ মোঃ শহীদুল ইসলামের বেতন ভাতার ১৬ লাখ ২২ হাজার ৭০০ টাকা স্বাক্ষর জালিয়াতি করে উত্তোলন করার প্রমান পায়। এব্যাপারে সভাপতি, অধ্যক্ষ এবং সংশ্লিষ্ঠ ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু উক্ত তদন্ত প্রতিবেদন দীর্ঘদিন ধামাচাপা পড়ে আছে। সংসদ সদস্যগণ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না হাইকোটের এমন একটি আদেশের পর ২০২০ সালের জুলাই মাসে কলেজটির সভাপতির পদ গ্রহণ করেন সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক। কিন্তু কিছুদিন পরে জেলা প্রশাসকের পরিবর্তে সংসদ সদস্যের একান্ত আস্থাভাজন মকসুমুল হাকিম কলেজটির সভাপতির পদে আসীন হন।
সাতক্ষীরা সিটি কলেজে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারী ১০ম সংসদীয় নির্বাচনে মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি জয়লাভ করেন। সাতক্ষীরা সিটি কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে ঐ বছরের মার্চ মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকে কলেজ অধ্যক্ষ আবু সাঈদকে ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ, এমপিও বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ তহবিল আত্মসাতের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করেছেন। সভাপতি থাকাকালিন প্রথম তিন অর্থবছরে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রাক্তন উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামান, শিক্ষা পরিদর্শক মোঃ হেমায়েত উদ্দীন এবং প্রাক্তন অডিট অফিসার মো: মোখলেছুর রহমান গত ২০১৭ সালের ২৫ মে সাতক্ষীরা সিটি কলেজটি সরেজমিনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করেন। উক্ত দপ্তরের পরিচালক প্রফেসর মোঃ জাহাঙ্গীর হোসন ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, উপাধ্যক্ষ মোঃ শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা থাকায় তিনি সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। অধ্যক্ষ আবু সাঈদের উপস্থাপিত কলেজের সরকারি বেতন বিল বহি যাচাই করে দেখা যায়, উপাধ্যক্ষ মোঃ শহিদুল ইসলাম সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায় হাজিরা খাতায় ও সরকারি বেতন বিল বহিতে তার স্বাক্ষর বা অনুস্বাক্ষর নেই। উপাধ্যক্ষ ধারাবাহিক অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সভাপতি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ও অধ্যক্ষ আবু সাঈদ তাঁর নামে বিল করে তদন্তকালিন সময় ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছরে বেতন ভাতা বাবদ ১৬ লাখ ২২ হাজার ৭০০ টাকা তুলেছেন যা’ সরকারি কোষাগারে ফেরতযোগ্য। পরিদর্শনের পর উপাধ্যক্ষের নামে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বিল করে টাকা উত্তোলন করা হলে তাও সরকারি কোষাগারে ফেরতযোগ্য। এখানে উল্লেখ্য যে, তদন্তের পর ৫ বছরে আরো ২৭ লাখ চার হাজার ৬০০ টাকা বেতন ভাতা হিসেবে তোলা টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত হওয়া উচিত।
প্রতিবেদনে আরোও উল্লেখ করা হয় যে, জেলা জামায়াতের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ মোঃ শহিদুল ইসলাম জেলে আছেন কিনা, কত তারিখ হতে বরখাস্ত, কত তারিখ হতে কলেজে আসেন না এ সংক্রান্ত রেকর্ড ও তথ্য চাওয়া হলেও অধ্যক্ষ আবু সাঈদ তথ্য প্রদান করেননি। শুধু লিখিত বক্তব্যে জানান, অত্র কলেজের উপাধ্যক্ষ মোঃ শহিদুল ইসলাম আমার যোগদানের পূর্বেই কলেজ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন। তিনি বিধি মোতাবেক ৫০ শতাংশ জীবন ধারণ ভাতা পান। তবে কলেজের কতিপয় শিক্ষক লিখিত ও মৌখিকভাবে জানান যে, উপাধ্যক্ষ মোঃ শহিদুল ইসলাম জেলে আছেন। সমায়িক বরখাস্ত অবস্থায় উপাধ্যক্ষের মাসওয়ারী সরকারি সমুদয় বেতন ভাতা উত্তোলন করা হয়েছে। উপাধ্যক্ষের পাঁচ বছরের ধারবাহিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তার নামে বিল করে আর্থিক বিধি লংঘন করে ব্যাংক হতে টাকা উত্তোলন করায় তৎকালিন সভাপতি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, অধ্যক্ষ মোঃ আবু সাঈদ এবং সমসাময়িক সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা দায়ী। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদনে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের সাথে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ থাকলেও সেটি গোপন থেকে যায় এবং পরবর্তীতে তার মনোনীত ব্যক্তিগত সচিব মোকছুমুল হাকিমকে সভাপতি বানিয়ে একই প্রক্রিয়ায় সেটি গোপন রেখেছেন।
এদিকে খোজ নিয়ে জানা গেছে, তদন্ত পরবর্তী তিন বছরে (জুন/২০১৭ থেকে জুলাই/২০২০) সভাপতি রবি ও অধ্যক্ষ আবু সাঈদ কলেজের অভ্যন্তরীন তহবিল থেকে প্রায় ছয় কোটি টাকা এবং নিয়োগ ও এমপিও বাণিজ্যে ৪ কোটিসহ প্রায় ১০ কোটি টাকা পকেটস্থ করেছেন। একই প্রক্রিয়ায় ২০২০ ইং সালের জুলাই মাসের পরে মীর মোস্তাক আহমেদ রবি নিয়ন্ত্রিত পরিচালনা পরিষদ জামায়েত নেতা ও উপাধ্যক্ষ মোঃ শহিদুল ইসলাম ২০২২ ইং সালের মার্চ মাসে অবসরে গেলে সমমনা আরেক জামায়েত নেতা মোঃ আলতাফ হোসেনকে উপাধ্যক্ষ হিসেবে ২০২২ ইং সালের জুন মাসে একটি পাতানো নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে ২৫/৩০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। পরবর্তিতে চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির মামলায় সদ্য কারামুক্ত অধ্যক্ষ আবু সাঈদ অবসরে গেলে সভাপতি ও অধ্যক্ষের অনিয়ম ও দুর্নীতিকে আড়াল করার জন্য বড়দল এপিএস কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ ড. শিহাবুদ্দীনকে একটি পাতানো নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে ৩০-৩৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর সিটি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করান। তবে মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি ইতোপূর্বে সিটি কলেজের সভাপতি থাকালিন তার অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা বারবার অস্বীকার করেছেন সাংবাদিকদের কাছে।
সিটি কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ড. শিহাবউদ্দিন অনিয়ম ও দূর্ণীতির মাধ্যমে সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের বিষয়টি ইতোপূর্বে সাংবাদিকদের কাছে অস্বীকার করে বলেন, তিনি কলেজে যোগদানের পর থেকে পূর্বে ঘটে যাওয়া অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় নিয়ে বর্তমান সভাপতি মোকসুমুল হাকিমকে নিয়ে শিক্ষা সচিব, মাউশি’র মহাপরিচালক ও দুদকসহ বিভিন্ন উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে জবাবদিহিতা করেছেন। প্রয়োজনে তাদের ডাকে আবারো যেতে হবে।
১৬ ঘন্টা ২১ মিনিট আগে
৩ দিন ১ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে
৩ দিন ১ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
৩ দিন ১ ঘন্টা ২১ মিনিট আগে
৩ দিন ১ ঘন্টা ২৭ মিনিট আগে
৩ দিন ১১ ঘন্টা ৫২ মিনিট আগে
৩ দিন ১২ ঘন্টা ৬ মিনিট আগে
৩ দিন ১২ ঘন্টা ১৮ মিনিট আগে