◾ অমিত হাসান
প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে কিছু দিন হলো হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি । উপজেলার সবচেয়ে নামকরা স্কুল । প্রতি বছর ভালো ফলাফল ছাড়াও স্কুলটির আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে স্কুলটির মনোমুগ্ধকর পরিবেশ । শীতলক্ষ্যা নদীর কোল ঘেষে অবস্থিত এই স্কুলটি নির্মিত হয়েছে সেই ব্রিটিশদের শাসনামলে । তারপর থেকে কত গুণীজনের বিদ্যাপীঠই না ছিল এই প্রতিষ্ঠান । কালের প্রবাহে আমারও সুযোগ হয় স্কুলটিতে অধ্যয়নের ।
২০১২ সাল । ক্লাস সিক্সে পড়ি । স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মূলপর্বে বিভিন্ন ইভেন্টের খেলা চলমান । শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে একের পর এক বিভিন্ন ইভেন্টে নিজেদের মুন্সীয়ানা দেখিয়ে যাচ্ছে । কিছুক্ষণের মধ্যে এলো আমার পালা । ১০০ মিটার স্প্রিন্টে (একক) দৌড়াতে হবে আমায় । সবাই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে নিচ্ছে । কিন্তু আমার বুকের ভেতর চাপা ভয় । আমি কি পারবো ? আর না পারলে আমায় নিয়ে সবাই হাসাহাসি করবে না তো ? নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ,নতুন বন্ধু-বান্ধব । ভয় আর উৎকন্ঠায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে । মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি পালাবো । খেলায় হারের আগেই হার মেনে নিতে যাচ্ছিলাম । আর নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দিলাম যে, প্রতিযোগিতায় জিততে পারলে যা পুরষ্কার পেতে পারতাম তাঁর জন্য মন খারাপও করবো না । বরং বাসায় গিয়ে মা কে বলবো বিজয়ীরা যে পুরুষ্কার পায় সেটা দোকান থেকে কিনে দিতে । যেই ভাবা সেই কাজ । প্রতিযোগিতার ট্র্যাক থেকে পালিয়ে বাড়ি ফিরতে আমি এগিয়ে চলছি ।
ছবি: লেখকের স্মৃতিময় স্কুল
স্কুলের পেছন দিকটার ওয়াল টপকে পালানোর ক্ষেত্রে অন্যদিন হলে বন্ধুরাই সাহায্য করতো । কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সেদিন বন্ধুরাই আমার বিপক্ষে । আজকাল দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ইভেন্টে খেলার নাম করে পিকনিক ফেরত কর্মকর্তারা যেমন বলে-'জয়-পরাজয় বড় নয়,অংশগ্রহণটাই বড়' বন্ধুরাও তেমনটাই বললো । তারপর কী আর করা ! সহপাঠী,বন্ধু সবার জোরাজোরিতো অগত্যা ১০০ মিটারের স্প্রিন্টে দাঁড়ালাম । কিন্তু আমার দুষ্ট বুদ্ধিগুলো তখনো মাথায় ঘুরপাক করছিলো । মনে মনে ঠিক করেছি হুইসেল বাজার পর একটু দৌড়ে ইচ্ছে করেই মাটিতে পড়ে যাবো । মনে হচ্ছিলো পারবো তো না এমনিতেই । আর এই ভাণটা করলে হয়তো অন্তত ইনজুট অজুহাত দিয়ে লোকেদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য থেকে বেঁচে যেতে পারি ।
তারপর প্রতিযোগিতা শুরুর পর এই পরিকল্পনাটাও অন্য পরিকল্পনাগুলোর মতো শুধু পরিকল্পনাই রয়ে গেলো । হুইসেল বাজার সাথে সাথে পায়ে অপ্রত্যাশিত কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করলাম । সাথেসাথে এক বন্ধু খানিকটা দূরে থেকে চিৎকার করে বললো,'সাপ,সাপ,অমিত দেখ তর পায়ের কাছে সাপ' ! আমি আর পিছনে ফিরে তাকানোর সাহস করতে না পেরে সোজা দৌড় । তখন সবাই দৌড়াচ্ছে প্রথম হতে,আর আমি দৌড়াচ্ছি সাপের ভয়ে ।
ছবি: লেখকের স্মৃতিময় স্কুল
তারপর ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো । সেরা সেরা দৌড়বিদরা আমার জীবন বাঁচানো দৌড়ের কাছে হেরেই গেলো । যে আমি কিছুক্ষণ আগে প্রতিযোগিতার মঞ্চ থেকে পালাতে চাচ্ছিলাম সেই আমিই প্রথম হয়েছি । এ অভাবনীয় ফলাফলে বিস্মিত আমি মনে মনে আরেকটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি । যাঁদের জন্য আমি প্রথম হয়েছি পুরষ্কার পেয়ে তাঁদেরই দিয়ে দিবো । কারণ এই প্রথম হওয়ার পেছনে আমার নিজের অবদান একেবারে নেই বললেই চলে । কিন্তু এই ভাবনার মধ্যেও ঘটে যায় নতুন আরেক বিপত্তি ।
আমার প্রথম হওয়ার পেছনে কার অবদান বেশি এই নিয়ে অন ফিল্ড বন্ধুরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে । এতে করে আসল ঘটনাটাও মুহূর্তের মধ্যে পুরো স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে । দায়িত্বশীল স্যাররাও কিছুক্ষণের মধ্যে সবটা জানতে পেরে যায় এবং আমাকে শাস্তি হিসেবে ডিস কোয়ালিফাই ঘোষণা করে যে দ্বিতীয় হয় তাকে প্রথম ঘোষণা করে । এতে আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ না থাকলেও একটা প্রশ্ন এখনো আছে । পুরনো স্মৃতি মনে পড়লে আমি এখনো ভাবি সেদিন আমার প্রথম হওয়ার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল ? যে বন্ধু গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করেছে তাঁর ? নাকি যারা পালাতে দেয় নি তাদের ? নাকি যে বন্ধু খেলনা সাপ আনার পরিকল্পনা করেছে সে বন্ধুর ? নাকি যে বন্ধু খেলনা সাপ ঠিক জায়গামতো মারতে পেরেছে সে বন্ধুর ? নাকি যে বন্ধু শেষ মুহূর্তে আমাকে সতর্ক করেছে সেই বন্ধুটার ?
৩০ দিন ৪ ঘন্টা ৫৯ মিনিট আগে
৯১ দিন ১৪ ঘন্টা ৩২ মিনিট আগে
১১৩ দিন ১৫ ঘন্টা ৪৯ মিনিট আগে
১১৬ দিন ২ ঘন্টা ৩৫ মিনিট আগে
১২৩ দিন ২১ ঘন্টা ১৫ মিনিট আগে
১২৭ দিন ১০ ঘন্টা ৫৮ মিনিট আগে
১৩৭ দিন ১৬ ঘন্টা ৫ মিনিট আগে
১৪০ দিন ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট আগে