◾অমিত হাসান : ঢাকা কলেজ। বাঙালির ঐতিহ্য আর গৌরবের ঢাকা কলেজ। ২০১৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করার পর আমার সামনে সুযোগ ছিল ঢাকার বাইরের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ঢাকায় ঢাকা কলেজ বেছে নেওয়ার। একদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অন্যদিকে দেশের প্রথম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম বেশ। তারপর মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা কলেজেই ভর্তি হবো। আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর। গাজীপুর থেকে ঢাকার দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায় বোধ হয় মা অমত করেন নি। অবশ্য অমত করার কোনো কারণও ছিল না। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও শিক্ষা বিপ্লবের গৌরবময় সাক্ষী এই বিদ্যাপীঠ।
যুগের পর যুগ ধরে এই অঞ্চল বিনির্মানে অগণিত কান্ডারী তৈরি করেছে ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বর্তমানে কলেজটি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাতেও অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে ঢাকা কলেজের।
ঢাকা কলেজের মূল ফটকে লেখকের তোলা ছবি।
২০১৯-২০ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেই মূলত ঢাকা কলেজে ভর্তির সুযোগ হয় আমার। তারপর থেকে এখন অব্দি কতশত আবেগ, স্মৃতি, ভালোবাসায় জড়িয়ে গিয়েছি এই ক্যাম্পাসটির সঙ্গে। ২০২০ সাল ঢাকা কলেজে আমার প্রথম বর্ষ। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে প্রথম বর্ষের নতুন শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের যে সংস্কৃতি সেখানে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসের সিনিয়র ভাইয়ারা আমাকে অনেক স্নেহ করলেন। এক বড় ভাই তো দুষ্টামির ছলে একটা ব্যানার দেখালেন, 'এসো নবীন ভয় নাই, ঢাকা কলেজে মেয়ে নাই!' ঢাকা কলেজ ছেলেদের কলেজ সেটা জেনেই ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু বড় ভাইদের থেকে এরকম একটা অভ্যর্থনা পাবো তা হয়ত কল্পনাও করি নি। অবশ্য বেশ ভালোই লেগেছে।
গাজীপুর থেকে এসে গিয়েই প্রথম কয়েক সপ্তাহ ক্লাস করেছি। এরমধ্যে ক্যাম্পাস এবং ক্যাম্পাসের বাইরে প্রচুর বন্ধু জুটে আমার। ক্যাম্পাসে সহপাঠী, ব্যাচমেটদের সঙ্গে আমার খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব হয়। কয়েকজন সিনিয়র ভাইকেও পাই। যারা ক্যাম্পাসে নতুন অবস্থায় আমাকে বেশ সাহায্য করেছে। আবার গাজীপুর থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতে গিয়ে পথে, ঘাটে, মাঠে, ট্রেনে, বাসেও বিভিন্ন রকম মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি। হকার থেকে শুরু করে বড় বড় অফিসার সবার সাথেই মেশার সুযোগ হয়।
কিন্তু নষ্ট হতো প্রচুর সময় আর ভাড়ার জন্য অর্থ। সময়ের অপচয় কমিয়ে আনতে অবশ্য আমার চেষ্টার কমতি ছিল না। সকাল সকাল ক্যাম্পাসে এসে চলে যেতাম লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে পছন্দের একাডেমিক বা নন একাডেমিক বই নিয়ে তারপর সোজা রিডিং রুমে। ক্লাস শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই। তাছাড়া যানজটের সময় কিংবা ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় বসেবসে বই পড়ারও একটা অভ্যাস করে নিয়েছিলাম।
কিন্তু জার্নির কারণে শরীরে ক্লান্তি ঝেঁকে বসতেও সময় লাগে নি বেশি। ঢাকার তীব্র যানজট আর ভিড় পেরিয়ে প্রতিদিন গাজীপুর থেকে ঢাকায় এসে ক্লাস করাটা আমার জন্য রীতিমতো কষ্টকর হয়ে যায়। অসুস্থও হয়ে পরি একসময়। কলেজের ছাত্রাবাসে সিট নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসে সিট পাওয়া যে সোনার হরিণ। ২০২০ সালের তৎকালীন প্রেক্ষাপটে অনার্স প্রথম বর্ষের একটা ছাত্রর জন্য তা ছিল আরো কঠিন। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে তাদের হলগুলোতে কয়েকদিনের অতিথি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু নিজের ক্যাম্পাসের আবাসিক ছাত্র হতে না পেয়ে বেশ মন খারাপই হয়। এরপর ধানমন্ডির একটা বয়েস মেসের একটা সিট ভাড়া নেই। ভাড়া নেই না বলে ভাড়া দেই বললেই হয়ত বলাটা সঠিক হবে। কারণ ভাড়া এডভান্স করে, আমার মালপত্র রেখে আসার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকে। বন্ধ হতে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এভাবেই প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল অফলাইনে সশরীরে পাঠ কার্যক্রম।
লেখকের স্মৃতিময় দিনগুলো কেটেছে উপমহাদেশের প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠের বুকে।
আমি অবশ্য বুদ্ধি করে কলেজ বন্ধের কয়েক দিনের মধ্যেই মেসের ম্যানেজারকে বলে দিয়েছিলাম আমি আর ওদের মেসে থাকবো না। যদিও আমার মেস ভাড়া এডভান্স করা ছিল আর আমি একদিনও সেখানে থাকি নি তবুও আমার মালপত্র ফেরত পাওয়া হয় নি। এতে অবশ্য আমার চেয়ে মা রাগ করেছেন বেশি। কারণ মা আমাকে যে জিনিসগুলো বাড়ি থেকে দিয়েছিলেন তাঁর মধ্যে একটা কাঁথা ছিল আমার নানি অর্থাৎ মায়ের মায়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন।
এরপর করোনার প্রকোপ কমে এলে খুব সম্ভবত ২০২১ সালের অক্টোবরে আমাদের অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা হয় অফলাইনে। কেন্দ্র ইডেন মহিলা কলেজ। ইডেনের ক্যাম্পাসটা সুন্দর অস্বীকার করব না। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ করার পর থেকে গত কয়েক বছর মনে হয় খুব দ্রুত কেটে গেছে। মনে হয় চোখের পলক ফেলেছি মাত্র। এরমধ্যে আমি ঢাকা কলেজের দক্ষিণ ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্র। কলেজের একটি সংগঠনের সভাপতিত্ব করেছি। ক্যাম্পাসে অনেক বন্ধু। তাছাড়া আছে কত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, সিনিয়র -জুনিয়র। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই ক্যাম্পাসটা ছেড়ে খুব দ্রুতই চলে যেতে হবে। বাস্তবতার নিয়মেই।
সময় কত দ্রুত ফুরিয়ে যায় আর কত দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলে! এখন নিজেকে আয়নার সামনে মনে হয় এই আমি তো অন্য আমি। প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ মনে হয় চোখের দুটি পলক ফেলেছি মাত্র। তবু জানি জীবন চলবে জীবনেরই নিয়মে৷ সময় বদলাবে। কিন্তু ঢাকা কলেজে গত কয়েক বছরে যে অসংখ্য সুন্দর ভালো লাগার মুহূর্ত তৈরি হয়েছে তা হয়ত ফেরত পাবো না আর কখনোই।
লেখক: অমিত হাসান
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা
সেশন: ২০১৯-২০
২৩ দিন ১৪ ঘন্টা ১৩ মিনিট আগে
৮৪ দিন ২৩ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
১০৭ দিন ১ ঘন্টা ৩ মিনিট আগে
১০৯ দিন ১১ ঘন্টা ৫০ মিনিট আগে
১১৭ দিন ৬ ঘন্টা ২৯ মিনিট আগে
১২০ দিন ২০ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে
১৩১ দিন ১ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে
১৩৪ দিন ৯ ঘন্টা ১১ মিনিট আগে