কক্সবাজারের টেকনাফের উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ের গহীন অরণ্য এখন অপহরণকারীদের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। শুধু বাহারছড়া ইউনিয়নেই গত ৩ বছরে অপহরণ হয়েছে ৪৯ জন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেলেও অনেকে অপহরণকারীদের চাহিদা মেটাতে না পারায় ফিরতে পারেনি নিজ পরিবারের কাছে। সম্প্রতি বড় আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুল শিক্ষার্থীদের অপহরণ। এক স্কুলেই অপহরণ হয়েছে চার শিক্ষার্থী। এই ভয়ংকর থাবা থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের সহযোগিতা চাইছেন আতংকিত লোকজন।
টেকনাফের বাহারছড়ার অপহরণচক্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে ডাকা মানববন্ধনে প্রায় ৩ শতাধিক লোকজন অংশগ্রহণ করেন। যেখানে স্কুল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণী পেশার লোকজন উপস্থিতি ছিল।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, টেকনাফের পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় কে কখন অপহরণ হয় তার কোন নিশ্চয়তা নেই। পাহাড়ে থাকা এই অপহরণকারীরা খুবই ভয়ংকর। তারা প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ে দিন-দুপুরে অপহরণ করে নিয়ে যায় গহীন অরণ্যে। পরে পরিবারের কাছে ফোন করে চায় মুক্তিপণ। চাহিদা অনুযায়ী মুক্তিপণ দিতে পারলে পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারে। নয়ত না। অপহৃত অনেকের লাশ পাওয়া গেছে জঙ্গলের ভিতরে। আবার অনেকের খবরই পাওয়া যায়নি কোনদিন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বনরক্ষী পর্যন্ত রক্ষা পাচ্ছেনা অপহরণকারীদের হাত থেকে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়না। যে প্রতিবাদ করবে তারই অপহরণের ঝুঁকি থাকে। অপহরণকারীর সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরিচিতির ছদ্মবেশে এলাকাতেই অবস্থান করেন। একের পর এক অপহরণের ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও অসন্তুষ্ট এলাকার লোকজন।
সর্বশেষ গত ১২ ফেব্রুয়ারী আব্দুল আমিন (১৪) নামে এক শিক্ষার্থী অপহৃত হয়। তিনি টেকনাফের বাহারছড়া মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। আব্দুল আমিন বাহারছড়ার মাথা ভাঙ্গা এলাকার মোক্তার আহমদের ছেলে। এই অপহরণের ঘটনার পরেই মারিশবনিয়া এলাকায় মানববন্ধন হয়। যেখানে ওই এলাকার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেন। এই অপহরণের ঘটনায় শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করা টেকনাফের বাহারছড়া মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, তারা প্রতিনিয়ত আতংকের মধ্যে রয়েছেন। ভয় করে কখন না কখন আব্দুল আমিনের মত অপহরণের শিকার হয়। তারা স্কুলে আসতে-যেতে এমনকি ঘর থেকে বের হতেও ভয় পায়। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরে যায়। আতংকিত অভিভাবকরা সন্তানদের নিতে স্কুলে এসে অপেক্ষা করে। জীবন জীবিকার কারণে অনেকে চাইলেও সন্তানদের নিতে আসতে পারেনা। এতে লেখা-পাড়ার খুবই ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে।
আব্দুল আমিনের বাবা মোক্তার আহম্মদ জানান, সেদিন পাহাড়ের পানের বরজে (বাগান) পান তুলতে গিয়েছিল আব্দুল আমিন ও তার মা-বোন-ভাই ৪ জন। হঠাৎ পাহাড়ি ডাকাত তাদের ঘিরে ফেলে এবং আমার ছেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ওই সময় ডাকাতরা ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে।
স্থানীয় সচেতন যুবক জয়নাল উদ্দিন জানান, পাহাড়ি ডাকাতের কারণে আমাদের জীবন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। বাহারছড়া ইউনিয়নে প্রতিনিয়ত অপহরণ হচ্ছে। এতে এলাকার লোকজন খুবই আতংকিত। অপহরণকারীরা শুধু অপহরণ’ই করে না; তারা মারাত্বকভাবে অত্যাচার করে। এমনকি খুন পর্যন্ত করে। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই দাবী, যেন অপহরণ বন্ধ হয়।
মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি সাইফুল ইসলাম জানান, অপহরণ যেন এই এলাকার স্বাভাবিক ঘটনা। শুধু মারিশবনিয়া থেকেই ১৩ জন অপহরণ হয়েছে। তার মধ্যে ৪ জন স্কুল শিক্ষার্থী। যার ফলে অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইছে না। প্রশাসন আন্তরিক হলে হয়ত এই অপরাধ বন্ধ হত। পাশাপাশি এই অপহরণ সিন্ডিকেটের সাথে এলাকার মধ্যে যেসব লোকজন জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী।
মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ইদ্রিস জানান, ‘এই জায়গাটা এমনিতে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়া একটি এলাকা। তার মধ্যে একের পর এক স্কুল শিক্ষার্থী অপহরণ হওয়ায় লোকজন তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেনা। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা করছি আর কোন আব্দুল আমিনকে যেন অপহরণের শিকার হতে না হয়। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ কামনা করছি।’
টেকনাফ বাহাছড়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ ফরিদ উল্লাহ্ জানান, ২০১৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৪৯ জনের মত অপহরণ হয়েছে। বেশ কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেছে। আবার অনেকের খবর পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগকে মুক্তিপণ দিয়েই উদ্ধার করা হয়। ৭ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত অপহরণকারীদের হাত থেকে বাচঁতে পারছেনা। প্রশাসনের কাছ থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাওয়া যায়না। তাদের অভিযোগ করলে আন্তরিকভাবে কাজ করেনা। পরে পরিবারের লোকজন মুক্তিপণ দিয়েই তাদের ছাড়িয়ে আনে। এই এলাকায় বেশিরভাগ লোকজন দরিদ্র। অনেকে চাহিদা অনুযায়ী মুক্তিপণ দিতে না পারায় প্রিয় সন্তুান-ভাই অথবা স্বামীকে হারাচ্ছেন। এই অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, ওই এলাকায় অপহরণের বিষয়গুলো প্রশাসন অবগত। অপহরণের খবর পাওয়া সাথে সাথে স্থানীয় লোকদের নিয়ে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে। এরই মধ্যে অনেককে উদ্ধারের পাশাপাশি অপহরণকারীদের আটক করা হয়েছে। তবে অনেক সময় অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য কৌশল অবলম্বন করতে হয়। যা অনেক অভিভাবক বুঝে উঠতে পারেনা। আবার অনেক অভিভাবক অভিযোগও করেনা। তবে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া স্থানীয়দের সহযোগিতায় অপহরণ প্রতিরোধে বড় এক অভিযান হতে যাচ্ছে।
এদিকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারী মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরেছে এর এক সপ্তাহ আগে অপহরণ হওয়া মারিশবনিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর স্কুল শিক্ষার্থী আব্দুল আমিন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই এলাকার ইউপি সদস্য ফরিদ উল্লাহ ও তার পরিবার।
এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের কাছে স্থানীয়দের দাবী তাদের যেন অপহরণের মরন থাবা থেকে রক্ষা করা হয়। এই অনিরাপদ জীবন থেকে মুক্তি পেতে তারা প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করছেন।
৪ দিন ১২ ঘন্টা ৭ মিনিট আগে
১৩ দিন ১৩ ঘন্টা ২৯ মিনিট আগে
১৬ দিন ১৫ ঘন্টা ২৮ মিনিট আগে
২৭ দিন ১৭ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
৪৭ দিন ১০ ঘন্টা ২৫ মিনিট আগে
৬০ দিন ১৪ ঘন্টা ৫৫ মিনিট আগে
৮৬ দিন ২০ ঘন্টা ১৫ মিনিট আগে
১০৪ দিন ২০ ঘন্টা ৪১ মিনিট আগে