ঘুরতে কার না ভালো লাগে। আমি খুব ঘুরতে পছন্দ করি। তাই অনেক দিন ধরে যাওয়ার ইচ্ছে হেমনগর জমিদারবাড়ী গোপালপুর। সময় হয়ে উঠে না। অধ্যাপনার পাশাপাশি সংবাদ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় কাটছে। সারা দিন কর্মব্যন্ত থাকার পর সন্ধ্যায় আড্ডা। কখন ঘুরে বেড়ানো। ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টা প্রতিনিয়তই প্রিয় ভাই জুবদিল খান ভাই চেপে ধরেন। জুবদিল খান মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের উপ প্রসাশনিক কর্মকর্তা এবং প্রেসক্লাবের সভাপতি হাবিবুর রহমান। সারা দেশ ঘুরে বেড়ানোই তার শখ। নেশাও বলতে পারেন। মধুপুরে যোগদানের পর থেকে আমার সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। মনের সাথে একটা মিল হয়ে উঠেছে। কাজের শেষে প্রতিদিন কোথাও ঘুরে বেড়ানোর লোভ সামলানো কঠিন। এক জন সোজা সাফটা মানুষ। যা হোক গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রেসক্লাবে আড্ডায় আলোচনায় উঠে আসে হেমনগর জমিদার বাড়ির কথা। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল জমিদার বাড়ি যাবার। সঙ্গী সাথী যে কয় জন হয়! যে কথা সে কাজ।
১০ সেপ্টেম্বর সকালে বের হলাম। গন্তব্য টাঙ্গাইলের গোপালপুরের হেমনগর জমিদার বাড়ি। বাইক মোটর সাইকেল। সাথে সহকর্মী মানব জমিনের সংবাদকর্মী আব্দুল্লাহ আল মামুন ভাই আর আমি। ছুটে চলছি। মাঝ পথে বৃষ্টি। কিছুক্ষণ থেমে পড়লাম। ততবেলায় হাবিব ভাই গোপালপুর শহরে। আধা ঘন্টা পর ওরা আমারা একত্র হলাম। ছুটে চললাম গোপালপুর। যাওয়ার পথে গ্রাম পল্লী প্রকৃতি দেখে দারুন মুগদ্ধ হলাম। বিলের পাড়ে শিবজাল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য অবিরাম। ও বলে রাখি গোপালপুর কিন্তু মধুপুরের থেকে নিচু এলাকা। মধুপুর বন্যা মুক্ত হবার কারণে কৃষি ফসলের বৈচিত্র্য বেশি।
যা হোক ছুটে চলছি। পথে পথে পাটকাঠির শুকাতে দেখা। অনেক দিন দেখি না। ফড়িং ধরার কথা মনে পড়ে গেল। ছোট বেলায় শোলাতে ফড়িং বসত, আর আমরা কজন নিয়মিত স্কুল থেকে এসে ফড়িং ধরতাম। এখন আমার গ্রামে সোনালী আশের চাষ হয় না।
এভাবে পৌঁছে গেলাম হেমনগর। জমিদার বাড়ির প্রবেশ পথেই হেমনগর কলেজের প্রধান ফটক। বাইক নিয়ে ভেতরে গেলাম। ঘুরে ঘুরে দেখে মুগ্ধ হলাম। শুধু আমিই নই, যে কেউ মুগ্ধ হবার কথা। জমিদার বাড়ির বিশাল আয়তনে বাড়ি, পুকুর, কলেজ, মাঠসব মিলিয়ে দারুন উপভোগ্য বিষয়।
স্থানীয়রা জানালেন, হেমনগর নামটি হয় মূলত হেম রাজার নাম অনুসারে। তিনি ছিলেন হেমনগরের জমিদার। জমিদারি প্রথা না থাকলেও রয়েছে জমিদারী আমলেও নানা স্থাপনা, সান বাঁধানো ঘাট, বিশাল মাঠ,সবুজ প্রকৃতিসহ নানা স্মৃতি।
প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে ভ্রমণ পিপাসুরা। দেখেন প্রাচীণ স্থাপত্যের সৌন্দর্যময় নিদর্শন। বিশাল জায়গা জুড়ে এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ জমিদার বাড়ি। যা ভ্রমন পিপাসুদের নজর কাঁড়ে।
হেমনগর জমিদার বাড়িটি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা শহর থেকে ১৪-১৫ কি. মি.পশ্চিমে হেমনগর গ্রামে অবস্থিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর নিপুন কারুকাজে খচিত হেমবাবুর জমিদার বাড়ীটি আজও সেই প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উচু করে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
প্রায় ১২৪ বছর আগে পুখুরিয়া পরগণার প্রভাবশালী জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী নিপুন শৈলীর এই বাড়িটি তৈরি করেন। তিনি ছিলেন মধুপুর উপজেলার আমবাড়ীয়ার জমিদারের উত্তরসূরি। হেমচন্দ্রের দাদা পদ্মলোচন রায় ব্রিটিশ স্যূাস্থ আইনের মাধ্যমে আমবাড়ীয়ার জমিদারী প্রাপ্ত হন। প্রথমে ১৮৮০ সালে হেমচন্দ্র তার আমবাড়ীয়ার জমিদার স্থানান্তরিত করে সুবর্ণখালিতে নির্মাণ করেন পরে রাজবাড়ীটি যমুনা গর্ভে বিলীন হওয়ায় ১৮৯০ সালে একটি নতুন দ্বিতল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা বর্তমানে জমিদার বাড়ি হিসেবে খ্যাত।
নিপুন কারুকাজের অনিন্দ্য সুন্দর জমিদার বাড়িটি পরীর দালান নামেও স্থানীয় ভাবে সমধিক পরিচিত। রাজবাডরি রাজসিক পরীর ভাস্কর্যের কারণেই এঞ্জেল হাউজ বা পরীর দালান হিসেবেও পরিচিত।
জ্যামিতিক এবং ফ্লোরাল নকশায় কারুকার্যমতি হেমনগর জমিদার বাড়িটি দিল্লি ও কলকাতার কারিগর দ্বারা তৈরি করা হয় । বিশাল জায়গা জুড়ে দ্বিতল জমিদারবাড়িটির প্রথম অংশে দ্বিতলা দরবার হল, পেছনে অন্দর মহল, বাড়ির সামনে রয়েছে মাঠ, জমিদার হেমচন্দ্রের দরবার ঘর, পেছনে রয়েছে বড় দুটি পুকুর। জমিদার বাড়ির আশেপাশে আরো ৭টি সুরম্য ভবন আছে যেগুলো জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর তিন বোন ও চার ছেলেমেয়ের বাড়ি। আর এই এঞ্জেল হাউজের ভেতরে বিশাল বড় একটা শানবাধানো পুকুর আর দশটি কুয়ো আছে। পুরো বাড়িটি নিপুণ হাতের ছোঁয়া ফোটে আছে শৈল্পিক। যা সবার নজর কাড়ে।
হেমচন্দ্র চৌধুরীর তিন বোনসহ সভ্রান্ত পরিবারের সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং মার্জিত রুচির কারণে পুরো পূর্ব বঙ্গ জুড়ে সুনাম ছিল। হেমচন্দ্রের পরিবারে এক ডজন সদস্য ছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসণে চাকরি করতেন। হেমচন্দ্র নিজেও কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে আইন হেমচন্দ্র তাঁর বাবার মৃত্যুর পর জমিদারীর দায়িত্ব পেলেন এবং তিনি তা বিস্তৃত করলেন। টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ মিলিয়ে তাঁর জমিদারীর এলাকা ছিল। তিনি শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং যোগাযোগ খাতে বিভিন্ন স্থাপনা প্রতিষ্ঠার জন্য জমি ও অর্থ প্রদান করতেন। তার দানকৃত জমিতে গড়ে উঠে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ভূমি, অফিসসহ নানা প্রতিষ্ঠান।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বাতিল হওয়ার পর তিনি কলকাতায় চলে যান । হেমনগরে আর কখনই ফেরেননি। ১৯১৫ সালে ভারতের ব্যানারসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৪৭ সালের পর সকলেই ভারতে চলে যান। পরে স্থানীয়রা জমিদার বাড়ী ঘেঁষে ১৯৭৯ সালে ‘হেমনগর খন্দকার আসাদুজ্জামান ডিগ্রি কলেজ’ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। বাড়িটি কলেজের অধীনে থাকলেও বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে না। হেমচন্দ্রের বংশধর কমল গাঙ্গগুলীর কন্যা নন্দিত সঙ্গীত শিল্পী ড. পৌলমী গাঙ্গুলী ২০১৮ সালে পুর্বপুরুষের ভিটেমাটি দেখার জন্য সম্প্রতি কলকাতা থেকে হেমনগরে আসেন।
সারা দিনের বেড়ানো জমিদার বাড়ি দেখা নিয়ে আমাদের চমৎকার অভিজ্ঞতা। প্রাচীন সময়ের নিপুণ কারুকাজ দারুন শিল্পের দারুন উপলব্ধি। জমিদার বেঁচে না থাকলেও তার কর্ম ও স্মৃতিই তাকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখবে।
৫৪৯ দিন ১৬ ঘন্টা ১০ মিনিট আগে
৫৫৩ দিন ২০ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
৫৮৬ দিন ১৩ ঘন্টা ৩২ মিনিট আগে