‘মানবিক করিডোর নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা হয়নি’ লালপুরে পদ্মা নদীতে ভরাট উত্তোলন নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ৪ কিশোরগঞ্জে খাবার খেয়ে একই পরিবারের ১৪ জন অচেতন মোংলা পৌরসভার ডাম্পিং বর্জ্যে দূষণ হচ্ছে সুন্দরবনের নদী ও পরিবেশ #দাবী পরিবেশবিদদের ঈদে জনসাধারণের নিরাপত্তায় কাজ করছে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন মাভাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আধিপত্য, চলছে অশ্লীল ও অসামাজিক কার্যক্রম নেত্রকোণার জুবেদা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে শৈলকুপায় মহিষ চুরি,রাতের আঁধারে এক জোড়া মহিষ উধাও বড়লেখায় পিকেএসএফ ও পদক্ষেপ'র উদ্যেগে যুব প্রশিক্ষণ কর্মশালা মোংলায় জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহের পুরষ্কার বিতরণেরণের মাধ্যমে সমাপনি গুচ্ছ ভর্তি আবেদনের সময়সীমা বাড়লো ১২ জুন পর্যন্ত ‎ ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতে দেওয়া হবে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ৪৮তম বিশেষ বিসিএস : প্রিলিমিনারি ও ফলাফলের তারিখ ঘোষণা আসছে আরেকটি নিম্নচাপ, জুনে হতে পারে বন্যাও শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে খেলতে ঢাকায় হামজা সান্তাহার ইউনিয়ন পরিষদে ভিজিএফের চাল বিতরণ আদমদীঘিতে বিভিন্ন কর্মসুচীর মধ্য দিয়ে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহের সমাপনী নোয়াখালীতে ভোটার হতে এসে দালালসহ রোহিঙ্গা নাগরিক আটক আদমদীঘিতে সড়কের পাশে পড়েছিল জাহাঙ্গীরের নিথর মরদেহ, উদ্ধার করল পুলিশ

বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ ও বিধবা বিবাহ

দেশচিত্র নিউজ ডেস্ক

প্রকাশের সময়: 25-12-2022 05:26:55 am


◾ রায়হান আহমাদ


আমি কমলাকান্তের ন্যায় কিঞ্চিত আফিম খেয়ে নিমিলিত লোচনে ঝিমুতে পারি না। বলা চলে এই যুগে আফিম বড় দুঃপ্রাপ্য বস্তু। এ জিনিসে নেশা করবার মতো পয়সা, উপায় কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নাই। তবে আমি বই পড়তে বড্ড বেশি ভালোবাসি। আর মাঝে মধ্যে একটু গঞ্জিকা সেবন করতেও বেশ ভালোবাসি। লোকে আমাকে দেখে মন্তব্য করে, ‘আহা বেচারা গাঁজাখোর বই পড়তে বড় ভালোবাসে।’ কেউ কেউ আমাকে বইপোকা কিংবা বইকীটও বলে। কিন্তু ওতে আমার বড্ড আপত্তি। আমি নিজেকে পাঠক বলতে বড় ভালোবাসি। এখানে আমার নামটা বরং উহ্যই থাক। পাঠক বলেই চিনুক লোকে।


বিকেলের তেজহীন রোদের মিষ্টি ছোঁয়া এখনো আমার গায়ে লেগে আছে। আমি বসে আছি তিতাস নদীর পাড়ে আমাদের বাগান বাড়িটির শেষ মাথায়। এখানে চেয়ার পেতে বসলে চলমান নদীর স্রোত আর ঠাণ্ডা মিষ্টি বাতাস বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ আগে বঙ্কিমবাবুর বিষবৃক্ষ বইটি পড়ে পাশের চেয়ারটায় তাকে আদর-যত্ন করে রেখে আমি সবুজ ঘাসের উপর আসন পেতে বসে শুকনো গঞ্জিকা পাতার কলকি সাজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কলকি সাজা হলে আয়েশ করে দুটো টান দিয়ে ঝিম ধরে বসে আছি। আকাশ বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম। এমত সময়ে আমার খোঁজে দুজন ভদ্রলোক এলেন। একজনকে দেখে আমি চিনলাম বটে। তিনি প্যান্ট-কোট টাই লাগানো বাবু। সরকারি চাকুরিজীবী বড় অফিসার এইটুকু ঠাহর করতে কষ্ট হয় না। কিন্তু চিনি-চিনি করেও চিনতে পারলাম না। কোথায় যেন দেখেছি ভাবতে ভাবতে আর জায়গার খোঁজ পেলাম না। চিনতেও পারলাম না। আমি বিনীতভাবে তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আর আমার পাশে এই যে ধূতি পাঞ্জাবি পরিহিত বাবুটিকে দেখিতেছো, তিনি শ্রী কমলাকান্ত।’


এতক্ষণে বঙ্কিমবাবুর মাতাল বিচারকটিকে চিনলাম। তাকে আদাব জানাতেই সে আমাকে বলল, ‘এক চিলতে আফিম হইবে বাবু?’ কিছুক্ষণ তার দিকে ফেল ফেল করে তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘এই যুগে আফিম দুঃপ্রাপ্য। একটা সিগারেট চান তো দিতে পারি।’


কমলাকান্ত  এই আশ্চর্য বস্তুটি হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে চিনতে পারলো, এ সাহেবদের বিড়ি। আমাকে বলল, ‘একটু আগুনটা দিন তো মশাই।’ আমি লাইটার দিয়ে তার সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। সে দু-টান দিয়ে বলল, ‘এক নম্বর তামাক বটে। বঙ্কিম দা, একটু ধুমপান করিয়া দেখিতে পারো।’ বঙ্কিমবাবু ইতস্তত করতে ছিলেন। সিগারেট নিবেন কিনা গভীর মনোযোগে ভাবতেছিলেন। আমি তার দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলে তিনি এক শলাকা নিলেন এবং আয়েশ করে টানতে লাগলেন। কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না। সিগারেট ফুকা শেষ হলে চেয়ার থেকে বিষবৃক্ষ তুলে নিলেন হাতে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটি আমার অতি উত্তম একখানা বহি। পাঠক তুমি পাঠ করিয়াছো?’ বললাম, ‘পড়েছি এবং প্রীত হয়েছি। কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্ন মনের খাঁচায় বন্দি হয়ে আছে। সম্মত হন তো আপনার সম্মুখে পিঞ্জিরা খুলে দিতে পারি।’


বঙ্কিমবাবু আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে বললেন, ‘নির্বিঘ্নে প্রশ্ন করিতে পারো। ইহাতে আমার কোনো আপত্তি নাই।’ বিনীতভাবে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার উপন্যাসে মহাকাব্যের অনেক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। আপনি কী মহাকাব্য লিখতে ব্যর্থ হয়ে উপন্যাস রচনা করতে আরম্ভ করেছেন?’


‘তুমি বড় মূর্খ পাঠক। এইটুকুও জানিতে ব্যর্থ হইয়াছো যে, উপন্যাসকে আধুনিক মহাকব্য বলিয়া ধরা হয়।’ কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বললাম, ‘অনেক আগে পড়েছিলাম বটে। এতো দিনে সেই পড়া হজম হয়ে গেছে। আপনার কাছে পূনরায় জানতে পেরে প্রিত হলাম।’


‘শোন হে মূর্খ পাঠক! যাহা পড়িবে তাহা সহজে বিস্মৃত হইবে না। ইহা বড় ভয়ঙ্কর।’

‘একবার পড়ে ভুলে যাওয়া আমার মহারোগ। কিছুতেই তার হাত থেকে রক্ষা পাই নাই। কী করবো যদি উপদেশ দেন।’

এমত সময়ে কমলাকান্ত বলিল, ‘বেশি বেশি আফিম খাও বাছাধন। সব মনে থাকিবে।’


তার কথায় কান না দিয়ে বঙ্কিমবাবুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তিনি খানিক ভেবে বললেন, ‘এই মহারোগের মহৌষধ আমার জানা নাই। তবে একটা বই কিছুদিন অন্তর অন্তর বারবার পড়িবে। তাহা হইলে স্বরণ থাকিতেও পারে।’


কমলাকান্ত বলিল, ‘একটু আফিম পাওয়া যাইবে বাবু?’

‘আফিম মিলবে না। তুমি বরং সিগারেট খেতে পারো।’ কমলাকান্ত তাহা নিয়াই মহাসুখে টানতে আরম্ভ করলে আমি বঙ্কিমবাবুকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কী ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন নাকি নাস্তিক?’

‘এই পাপ প্রশ্ন মুখে আনাও মহাপাপ। হরি হরি। আমি অবশ্যই ধার্মিক লোক। মনেপ্রাণে ধর্ম মানি। তুমি নির্বোধ বলিয়া আমার বহি পড়িয়াও তাহা ধরিতে পাড়িলে না। তোমার পাঠক জীবন কলঙ্কিত।’


বিনয়ের সহিত তার কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করে পুনরায় প্রশ্ন করলাম, ‘ধার্মিক লোক বুঝিলাম। কিন্তু গোড়া নন সে মানি। আপনার জীবনের সাথে শোনলাম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে বিষবৃক্ষের কাহিনী। এ কথা কতটুকু সত্যি?’


‘না গোড়া নই আমি। তবে বিষবৃক্ষের কাহিনী আমার জীবনের সহিত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িতও নহে। তবে ইহার কিছু কিছু কাহিনী আমার জীবন হইতে নেয়া একথা সত্য। বলিতে পারো আমার স্ত্রী ধর্মপ্রাণ। কিছুটা সূর্যমুখীর মতো স্বামীভক্ত।’


‘বুঝলাম। আপনি আপনার বিষবৃক্ষে বলেছেন, “...একটা হাসির কথা। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আসিয়াছেন, তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে!” সূর্যমুখীর পত্রে আপনার এমন লেখায় প্রতীয়মান হয় যে আপনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের পক্ষে মত দেননি। এমনকি তার বিধবা বিবাহ প্রচলনে দ্বিমত কিংবা বিরোধিতা করেই এই উপন্যাস রচনা করেছেন। এইকথা কতটুকু সত্যি?’


কমলাকান্ত অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছিলেন। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘এক চিলতে আফিমের ব্যবস্থা যদি করিতেন বাবু। পয়সা সে তো হাতের মূল্যবান ময়লা। চলিয়া গেলেও বেশি ক্ষতি হইবে না। ঈশ্বর দিবেন।’

বিরক্ত হয়ে তাকে বললুম, ‘আপনি বরং ঈশ্বরের কাছে আফিম ভিক্ষা করুন। তিনিও আপনাকে দিবেন।’

‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এ কি মহাপপের কথা।’বলেই জিব কাটলেন কমলাকান্ত। বঙ্কিমবাবুর এই কথায় মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। আমি পুনরায় আমার প্রশ্নের কথা মনে করিয়ে দিতে তিনি বললেন, ‘আমি ধার্মিক মানুষ। পিতা পিতামহের ঐতিহ্যবাহী ধর্ম মতের বিরুদ্ধে গিয়া ঈশ্বরবাবু যে এই বিধবা বিবাহ প্রচলণ করিলেন তাহা কেমন করিয়া মানিতে পারি বল? আমার স্ত্রীও এই প্রথার বিরুদ্ধে গিয়া রাম রাম করেছেন। ইহা ধর্মমধ্যে মহাপাপ বলিয়া আমি ইহার বিরুদ্ধে গিয়াছি এবং বিধবা বিবাহের সমালোচনা করিয়া এই গ্রন্থ লিখিয়াছি। এইখানে আমাকে নিশ্চয়ই কেউ গালি দেন নাই। মূলত সবাই এই বহির প্রশংসাই করিয়াছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অধিকাংশ শিক্ষিত ধার্মিক লোক ত্যাগ করিয়াছেন। অস্রাব্য ভাষায় গালিগালাজও যে করেন নাই তাহাও বলিতে পারি না। তুমি কী আমার বিষবৃক্ষের নিন্দা কর?’


‘কিছুতেই না। এটা একটা মূল্যবান বই বটে। কিন্তু আমি ঈশ্বরচন্দ্রের মত গ্রহণ করি।’

‘তুমি কি কুন্দনন্দিনীর পরিণতি দেখোনি? দেখোনি কি নগেন্দ্র আর সূর্যমুখীর জীবনের এই ট্রাজেডি? তবে কেন বিধাব বিবাহ সমর্থণ কর?’


‘বোধহয় ঈশ্বরবাবু গৃহে পতিপরায়ণা সুন্দরী সুশীলা স্ত্রী রেখে বিধবাকে বিবাহ করতে বলেন নাই তাই বিধাব বিবাহের এই পরিণতি অমূলক জ্ঞান করি।’

‘“প্রেমের পাক বিচ্ছেদে।”-এই কথা মনে নাই তোমার? নগেন্দ্র ভালোবাসিয়াছিল কুন্দনন্দিনীকে। তাই এই বিবাহ করিয়াছে। ভালোবাসার উপর কোনো কথা হইতে পারে না।’


‘কিন্তু আপনিই বলেছেন যে, সে প্রেম মোহ ছিল। আপনার ভাষায়, “আমি কেন কুন্দনন্দিকে বিবাহ করিয়া ছিলাম? আমি কি তাহকে ভালোবাসিতাম? ভালোবাসিতাম বই কি- তাহার জন্য উন্মাদগ্রস্থ হইতে বসিয়াছিলাম -প্রাণ বাহির হইতেছিল। কিন্তু এখন বুঝিতেছি, সে কেবল চোখের ভালোবাসা। নহিলে আজি পনের দিবসমাত্র বিবাহ করিয়াছি- এখনই বলিব কেন, “আমি তাহকে ভালোবাসিতাম?” ভালোবাসিতাম কেন? এখনও ভালবাসি- কিন্তু আমার সূর্য্যমুখী কোথায় গেল? ...” মোহের প্রেমে এমন ট্রাজেডি ঘটালেন কেন? সে আপনারই দোষ। বিধবা বিবাহের দোষ নয়।’


‘আমি এ কথাও বলিয়াছিলাম যে, “গুণজনিত প্রণয় চিরস্থায়ী বটে- কিন্তু গুণ চিনিতে দিন লাগে। এই জন্য সে প্রণয় একেবারে বলবান্ হয় না- ক্রমে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু রূপজ মোহ এককালীন সম্পূর্ণ বলবান্ হইবে। তাহার প্রথম বল এমন দুর্দ্দমনীয় হয় যে অন্য সকল বৃত্তি তদ্বারা উচ্ছিন্ন হয়। এই মোহ কি- এইস্থায়ী প্রণয় কি না- ইহা জানিবার শক্তি থাকে না। অনন্তকালস্থায়ী প্রণয় বলিয়া তাহাকে বিবেচনা হয়।”কিন্তু তুমি ভুলোমনা পাঠক। রূপজ মোহের দ্বারা সৃষ্ট প্রণয়ের শক্তি সমন্ধে তোমার কোনো ধারণা হয় নাই। এই কথা তোমার মনেও নাই। তুমি বড় বুদ্ধু।’


আমি বঙ্কিম বাবুর কথায় সম্মত হলাম। এবং আরও একটি প্রশ্ন না করে তাকে ছেড়ে দিতে পারি না। কিন্তু কমলাকান্তটা বড় উত্তক্ত করছে। কিছুক্ষণ পরপর বলছে, ‘এক চিলতে আফিম হইবে বাবু?’ বঙ্কিম বাবুও তার এমন আচরণে বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু এই মাতাল বিচারক কখনো অন্যায় বিচার করে না বলে তার সমস্ত কিছুই সহ্য করা যায়। আমি বঙ্কিমবাবুকে বসিয়ে রেখে কমলাকান্তকে সঙ্গে নিয়ে অনেকটা দূরত্বে বসলাম। বললাম, ‘আফিম পাওয়া যাবে না বিচারক মশায়। চান তো এক কলকি গঞ্জিকা দিতে পারি।’


কমলাকান্ত কিছুক্ষণ ভেবে মনমরা কণ্ঠে বললেন, ‘আফিম যখন যোগাড় হইবে না তখন যাহা দাও তাহাই চলিবে। দ্রুত আনো বাবু পাঠক, আর সহ্য হইতেছে না।’আমি এক কলকি গঞ্জিকা তৈরি করে জ্বালিয়ে কমলাকান্তর হাতে দিয়ে বিদায় লইলাম। বঙ্কিমবাবুর কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি বারবার ঘরি দেখছেন। বুঝলাম তার তাড়া আছে। তাই কিছুটা ইতস্তত করে বললাম, ‘আর কিছু প্রশ্ন করবো বাবু?’


‘দ্রুত কর। আমার যাওয়ার সময় হইয়াছে।’

‘আপনি নগেন্দ্রের পত্রে তারই হাত দিয়ে লেখলেন, “যদি কেহ বলে যে, বিধবাবিবাহ হিন্দুধর্ম্মবিরুদ্ধ, তাহাকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রবন্ধ পড়িতে দিই। যেখানে তাদৃশ শাস্ত্রবিশারদ মহামহোপাধ্যায় বলেন যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত, তখন কে ইহা অশাস্ত্র বলিবে?” বঙ্কিমবাবু, আপনি কি তবে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধাচারণ করেননি? নাকি কাহিনি সাজানোর জন্য এখানে প্রহসন করে পরবর্তীতে তার ভয়াবহ পরিমাণ বর্ণনা করে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন? আরেকটি প্রশ্ন মনে আসে। সে হলো, প্রথমে আপনি বিধবা বিবাহ সমর্থণ করেতেন কিন্তু আপনার স্ত্রী করেন না এবং তার জন্যই বিধবা বিবাহের বিরুধিতা করে এমন অসাধারন একটা পুস্তক রচনা করেছেন?’


‘হায় মূর্খ পাঠক! তোমাকে কেমন করিয়া বুঝাইবো যে আমি বিধবা বিবাহ সমর্থন কখনোই করি নাই। ধর্মপ্রাণ একজন হিন্দুর জন্য এই প্রথা মানিয়া লওয়া দুঃসাধ্য। তবে বিদ্যাসাগরের প্রবন্ধ পাঠ করিয়া সকলেই কিছুটা বিধবা বিবাহের সমর্থণ করিবেন এই কথা শিকার করিতেই হয়। শুধু মাত্র গোড়া ধার্মিক ছাড়া কিছুটা সমর্থণ সবারই করা উচিৎ বটে। আমার শ্রীমতি কখনো এই সমর্থণ করেন নাই। তাহাকে ভালোবাসিয়া আমিও একেবারেই বিরুধিতা করার লোকে নামিয়া আসিলাম।’


‘আপনি আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত হয়েও কেমন করে এতোটা ধার্মিক হলেন?’


‘শিক্ষা সবসময়ই আলোর পথ ধরিয়া চলে। আর ধর্ম ছাড়া আলো আসিতে পারে না। যাহারা নিজেদেরকে গোর-নাস্তিক দাবি করিয়া নিজস্ব মত ও পথে চলেন, দেখা যাইবে তাহারাও অনেক নিয়মকানুন মানিয়া একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হইয়া গিয়াছেন। এই যে নিয়মকানুনের বন্ধন, বোধকরি তাহাই ধর্ম। আমি মনে করি কেহই ধর্মের বাহিরে নাই।’


‘আপনার কাছে অনেক কিছু শিখতে পারলাম শ্রদ্ধেয় বঙ্কিমবাবু। এইবার বিষবৃক্ষ নিয়ে কিছু কৌতুহল নিবারণ করেই আপনার বাহন ডাকবো।’


‘বুদ্ধু পাঠক! দ্রুত কর। আমার সময় নাই।’

‘বিষবৃক্ষ রোপণ করতে গিয়ে আপনি শুরুতে এতোটা প্রহসণে কেন কাহিনি বর্ণনা করেছেন? কেন নিজ হাতে কুড়িয়ে এনে কুন্দনন্দিনীকে বিবাহ দিয়ে তাহাকে বিধবা করলেন? তারপর রোপন করলেন বিষকৃক্ষ। কেন সেই কুন্দকেই ভালোবাসিলেন নগেন্দ্রকে দিয়ে? গায়ের কিংবা দূরের যে কোনো বিধবার প্রেমে নগেন্দ্রকে ফেলেই তো কাহিনি শুরু করতে  পারতেন।’


‘তা পারিতাম বটে। কিন্তু স্বর্গে পৌঁছাইতে হইলে অনেক অনেক সিড়ি পাড়ি দিতে হয়। আমি বিষবৃক্ষ নামে যে স্বর্গ রচনা করিয়াছি তাহার রস পাইতে হলে পূর্বের বিস্বাদ সিড়িগুলো অতিক্রম করিতে হইবে। কালিদাস আর তার মালিনীর গল্প এতদ্রুত ভুলিয়া গিয়াছো?’


বঙ্কিমবাবুর কথায় গল্পটা মনে পড়ল। বিষবৃক্ষের রচনা সমন্ধে এই গল্প বলেছিলেন লেখক। আমিই ভুলে গেছি এ কার দোষ। সুতরাং লজ্জিত হইলাম। আবার প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার বিষবৃক্ষের সফলতায় কোন চরিত্রের অবধান শিকার না করলেই নয়?’


তিনি বললেন, ‘হীরা। তাহার হিংসা রোষেই এই বিষবৃক্ষ এতোটা সফল হইয়াছে। তাহাকে সঠিক ভাবে আঁকিতে না পারিলে বিষবৃক্ষ এতোটা সফল স্বার্থক হইতো বলিয়া ভ্রম হয়।’

‘সূর্য্যমুখীর গৃহত্যাগে যেই ট্রাডেজির সৃষ্টি করেছেন তাতে নগেন্দ্র আর সূর্য্যমুখীর দুঃখে পাঠকের চোখ ছল ছল করে উঠে। পাঠক জানতে পারে সূর্য্যমুখী মরে গেছে। ফের তাকে আবার জীবিত করে গৃহী করে ট্রাজেডির সমাপ্ত করলেন কেন?’


‘এই ট্রাজেডির সমাপ্তি না ঘটাইলে বিষবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করিয়া কুন্দের মরিবার পর কেহই আর বাঁচিয়া থাকিতে পারিত না। তখন মনে হইতো পৃথিবীতে বুঝি বা কোনো মানুষ বাঁচিয়া নাই। সবাই মরিয়া গিয়াছে। কাহিনিতে টুইস্ট আনিবার জন্যই তাহাদের ফের একত্রিত করিয়া দিয়াছি। কিন্তু এই ট্রাজিক পরিণতিতে উপন্যাস সমাপ্ত করিলেও মন্দ হইতো না।’

‘মহাপাপিষ্ঠা হীরাকে মারলেন না কেন?’

‘তাহার ভালোবাসা এবং কলঙ্কের কারণ সেই দেবেন্দ্রকে মারিয়াছি। এবং তাহাকে পাগল করিয়াছি ইহাতেই তাহার শাস্তি হইয়াছে। অযথা মানুষ হত্যা করিয়া ফল কী। বরং তাহার উপযুক্ত সাজা হওয়া বাঞ্চনীয়।’


‘আপনার আগমনে আমার মনে সোনা ফলেছে। আবার আসবার নিমন্ত্রণ রইলো। আর একটু বসুন মশাই। এই দরিদ্র মুসলমান পাঠকের বাড়িতে একটু ফলারের আয়োজন করা হয়েছে।’

‘আমি যদিও মুসলমানের বাটিতে কছিুই ভক্ষণ করি না তথাপি তুমি আমার পাঠক। তোমাকে ধর্মের দায়ে অবহেলা করিতে পারিনে। সাহিত্য আর সাহিত্যের পাঠকই কিনা সাহিত্যিকের সেরা ধর্ম সেরা সমাজ।’


আমি বঙ্কিমবাবুর ফলারের ব্যবস্থা সমাপ্ত করিলে তিনি এই পাঠকের বাটিতে আহার করিতে বসিলেন। এমতাবস্থায় হেলে ধুলে কমলাকান্তের আগমন ঘটল। আমাকে জোর করে বুকে চেপে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে অস্থির হলো। কাঁদার কারণ জিজ্ঞাস করলে বলল, ‘তুমি আজিকে আমায় যেই বস্তু খাওয়াইয়াছি তাহা অমৃত সমান। এই বস্তু কখনো আমি ভক্ষণ করি নাই। তোমার বাটিতে আজি হইতে এই মাতাল বিচারকের ঘণঘণ পদচারণা হইবে। আমাকে শুধু এই বস্তু দিয়া আপ্যায়ণ করিও।’


আমি এই কমলাকান্তের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাদের বিদায় পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার আজকের পাঠ এবং এই গঞ্জিকা সেবন সার্থক হলো।