◾ মো. আকিব হোসাইন : রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সরকারি সাতটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ পূর্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। কিন্তু, শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি উক্ত সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার মাধ্যমে মূলত এ কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু, পরবর্তীতে দৃশ্যমান এই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধিত হয় নি; বরং বেহাল ও নাজেহাল অবস্থায় পতিত হয়।
বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়া সংবলিত লিখিত অভিযোগ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছালেও তার সুদূর কোনো ফলাফল আসে নি। অধিকন্তু দেখা গেছে, সংকট ও সমস্যা অপরিবর্তিত অবস্থাই রয়ে গেছে। তবে, উল্লেখযোগ্য কিছু সমস্যার মধ্যে রয়েছে-
১. অবকাঠামোগত সমস্যা:
বর্তমানে সাত কলেজের মধ্যে একেক কলেজে রয়েছে একেক সমস্যা। হয়তো কোনো কলেজে কম কিংবা কোনো কলেজে বেশি। অবকাঠামোগত সমস্যা হচ্ছে সাত কলেজের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত সমস্যা। বেশিরভাগ কলেজে এখন পর্যাপ্ত পরিমাণে একাডেমিক ভবন নেই, নেই তেমন ক্লাসরুম, হল, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, অফিস কক্ষ, লাইব্রেরি ও পরিবহন ব্যবস্থা। এসব সমস্যার কথা দীর্ঘদিনের বটে। বিশেষ করে, ঢাকা কলেজে একাডেমিক ভবনের সংকট আজও বিদ্যমান। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ লাজ করছে। তাছাড়া হোস্টেলগুলোতে তেমন কোনো সুবিধা নেই। জরাজীর্ণ ভবন থাকায় পড়াশোনার পরিবেশও নেই। তাছাড়া ডাইনিং রুম এর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এভাবে ইডেন মহিলা কলেজে পর্যাপ্ত হোস্টেল, লাইব্রেরি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই। সরকারি বাঙলা কলেজও পর্যাপ্ত একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি, পরিবহন ব্যবস্থা ও হল এর সুবিধা কম। তাছাড়া সবচেয়ে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজে। সেখানে একাডেমিক ভবনের সংকট রয়েছে। এ দুটো কলেজের আয়তনও কম। নেই পর্যাপ্ত লাইব্রেরি, হল, ক্লাস রুম, পরিবহন ব্যবস্থা বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তাছাড়া বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজেরও আয়তন কম। পর্যাপ্ত একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি, হল ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অভাব রয়েছে। এদিকে সাত কলেজের অন্যতম বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীদের কলেজ হিসেবে পরিচিত সরকারি তিতুমীর কলেজেও একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি, হল, পরিবহন ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ব্যাপক সংকট রয়েছে।
২. শিক্ষক সংকট:
সরকারি সাত কলেজের বেশিরভাগ কলেজে ব্যাপক হারে শিক্ষক সংকট বিরাজমান। দেখা যায়, অধিকাংশ ডিপার্টমেন্টে শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। এসব বিষয়গুলোর সমাধান আজও হয় নি। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তদারকি বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ দৃশ্যমান নয়। শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষক নিয়োগ একদম কম থাকায় সাত কলেজের চলমান সংকট বাড়ছেই। এতে পাঠদানেও ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া অধিকাংশ শিক্ষকগণ পাঠদানে অমনোযোগী হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ব্যাপক সমস্যায় নিপতিত হচ্ছে।
৩. নিয়মিত পাঠদানের অভাব ও ফলাফল বিপর্যয়:
উক্ত কলেজগুলোতে নিয়মিত পাঠদান হচ্ছে না, ফলে ফলাফলে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। দেখা যায়, উক্ত কলেজগুলোতে বিভিন্ন বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা চলাকালীন ক্লাস বন্ধ থাকে, এতে করে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তদারকি বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ঘাটতির অভাব রয়েছে।
৪. যথাযথ সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়া ও সেশনজট:
দেখা যায়, অধিভুক্তির পর থেকে সাত কলেজের বিভিন্ন শ্রেণির বা বর্ষের জন্য সুনির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার বা পরিকল্পনা অনুযায়ী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। হঠাৎ করে চূড়ান্ত পরীক্ষার তারিখ ও রুটিন প্রকাশিত হয়ে যায়। এতে করে শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়, যা অন্যতম সংকট হিসেবে সুপরিচিত। এসব সংকটে চলছে দিনের পর দিন। কিন্তু আজও সমাধানের পথ নেই।
৫. পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে সমস্যা ও গণহারে ফেল করানো:
যখন বিভিন্ন বর্ষের ফাইনাল বা চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়। তখন এসব চূড়ান্ত পরীক্ষার খাতাগুলো মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনেক অবহেলা দৃশ্যমান হয়। কেউ কেউ ভালো পরীক্ষা দিলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন। আবার, অনেকে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিলেও ফলাফলে কোনো ধরনের পরিবর্তন হয় না। এতেও শিক্ষার্থীরা হাতাশায় নিমজ্জিত হন। তাছাড়া ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব করাও এক ধরণের সমস্যা হয়ে যায়। অনেক বিভাগের রেজাল্ট প্রকাশের ক্ষেত্রেও ৬ মাসের অধিক সময় লাগে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ মাসের মধ্যে রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। এদিক থেকে এটা এক ধরনের বৈষম্যও বটে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সাত কলেজে কয়েকটা বিভাগে গণহারে ফেলের বিষয় দেখা যায়। এটার কারণ আজও সুরাহা হয় নি।
৬. শিক্ষার মান উন্নয়নের নামে বৈষম্য:
সাত কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে, এই প্রত্যয়ে উক্ত সাতটি কলেজকে বিশ্বিবদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলেও প্রকৃত অর্থে তার কিয়দাংশেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও সুফল দেখা যায় নি। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা ও হতাশার দৃশ্য ভেসে উঠছে। স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া, চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ফরমপূরণ, পরীক্ষার আয়োজন, ফলাফল ও সনদ বিতরণেও এক ধরণের সংকট কাজ করছে। ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। এতে শিক্ষার কোনোরূপ উন্নতি হয় নি; বরং বৈষম্য ও সংকট ক্রমশ বেড়েছে বলা যায়।
৭. প্রশাসনিক ভোগান্তি:
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মুখোমুখি হতে হয়। এতে করেও নানান বৈষম্য ও সংকট সৃষ্টি হয়। লাল-ফিতার দৌরাত্ম্যে মার-প্যাঁচে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। প্রশাসনিক ভবনের যেখানে অধিভুক্ত কলেজের অফিসিয়াল কার্যক্রম সম্পন্ন করেন, সেখানেও শিক্ষার্থীদেরকে এক ধরণের হয়রানির শিকার হতে হয়। বিভিন্ন সময়ে নানান অভিযোগ দিলেও সেগুলো জমা হতে থাকে দিনের পর দিন। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা অধিভুক্তির সুফলের পরিবর্তে কুফল ভোগ করে বেশি।
৮. গবেষণার সুযোগ নেই:
ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ থাকলেও অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনোরূপ গবেষণার সুযোগ নেই। এটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা ও হতাশা কাজ করছে। এটা বৈষম্য বটে।
৯. সনদের ক্ষেত্রে বৈষম্য:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজ থেকে যারা যারা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে, তাদের সবাইকে নিয়মানুযায়ী সনদ বিতরণ করা হয়। কিন্তু, এক্ষেত্রেও এক ধরণের বৈষম্য দেখা যায়। সনদের মধ্যে যাবতীয় তথ্যগুলো অভিন্ন ফন্টে লেখা থাকলেও শুধু অধিভুক্ত শব্দটি ভিন্ন ফন্টে লেখা হয় বা খুব বড় করে দেখানো হয়। এতে বিভিন্ন সরকারি চাকরি ও অন্যান্য চাকরির ভাইভাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এটা নিয়েও শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
১০. প্রহসনের অনলাইন সমাবর্তন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে সমাবর্তনের আয়োজন করলেও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য করা হয় ভিন্ন আঙ্গিকে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এখানে একটি বিষয় দৃশ্যত যে, অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে অনলাইনে সমাবর্তনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের সাথে সংযোগ ঘটানো হয়। এতে করে অনেকে এটাকে প্রহসনের সমাবর্তন নামেও নামকরণ করেছে। এভাবে অবহেলা ও অনিয়মের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের মাঝে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অধিভুক্তির দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারকি বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে আজও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ এবং যথাযথ উন্নয়ন সাধিত হয়নি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি নিতে ব্যর্থ, সেহেতু শিক্ষার্থীরা ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সরকারি সাত কলেজকে নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তুলছেন। শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদেরকে নিয়ে শিক্ষা-বাণিজ্য গড়ে তুলছেন কিংবা শিক্ষায় সিন্ডিকেট গড়ে তুলছেন। শিক্ষার মানোন্নয়নের নামে বিভিন্ন সময় ফি আদায়ের মাধ্যমে সংকটকে চলমান রেখেছে। তাই এখন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি উত্থাপিত হচ্ছে যে, অধিভুক্তির বাতিল, স্বতন্ত্র কমিশন গঠনপূর্বক স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও তাদের বৈষম্য দূর করা। এতে করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন প্রয়োজনীয় কাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়নে সক্ষম হবেন।
আসলে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া ও প্রত্যাশা কতটুকু যৌক্তিক হবে কিংবা সুনির্দিষ্ট কতৃপক্ষের বিবেচনায় আসবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে চলমান সংকটের প্রেক্ষিতে। আশা করি, সাত কলেজের চলমান সংকট নিরসনে কতৃপক্ষের টনক নড়বে। মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে শিক্ষক সংকট ও শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া সংবলিত বিষয়াদি পূর্ণতা পাবে। তাছাড়া একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যদি যাবতীয় সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে কেন সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে না?
মো. আকিব হোসাইন
তরুণ কলাম লেখক ও সংগঠক
২৩ দিন ১৪ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে
৮৪ দিন ২৩ ঘন্টা ৪৫ মিনিট আগে
১০৭ দিন ১ ঘন্টা ২ মিনিট আগে
১০৯ দিন ১১ ঘন্টা ৪৯ মিনিট আগে
১১৭ দিন ৬ ঘন্টা ২৮ মিনিট আগে
১২০ দিন ২০ ঘন্টা ১১ মিনিট আগে
১৩১ দিন ১ ঘন্টা ১৮ মিনিট আগে
১৩৪ দিন ৯ ঘন্টা ১০ মিনিট আগে