খাল-বিল, নদী-নালায় চড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছের পোনা। কিছুদিনের মধ্যেই মাছগুলো বড় হবে। কিন্তু এরই মধ্যে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার নরসুন্দা ও সুতী নদীসহ বিভিন্ন হাওর-বিলে এক শ্রেণির মৎস্য শিকারি বেড় ও সুতি জাল দিয়ে লাটি মাছের পোনা সহ বিভিন্ন প্রজাতির পোনামাছ নিধন করছেন। এসব পোনামাছ বিভিন্ন হাটবাজারে প্রকাশ্যে বিক্রিও হচ্ছে। বেশির ভাগ মৎস্যজীবী দরিদ্র হওয়ায় রুটিরুজির বিকল্প উপায় না থাকায় এসব পোনামাছ ধরতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
নরসুন্দা ও সুতী নদী বেষ্টিত তাড়াইল উপজেলার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাল-বিলে বর্ষার পানি প্রবেশের পর থেকেই মাছ শিকারের ধুম পড়ে গেছে। নদী থেকে খাল-বিলে পানি প্রবেশের পথেই বেড় ও সুতি জাল দিয়ে ডিমওয়ালা মা মাছ নিধন করা হয়েছে। এখন চলছে পোনা মাছ নিধন। প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে এ মাছ শিকার। গ্রামের হাট-বাজারে এসব মাছ বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি তাড়াইল উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন বিলের পানি দ্রুতগতিতে নদীতে নামছে। পানি বের হওয়ার পথগুলোতে বসানো হয়েছে সুতি জাল, ভেসাল ও খড়া জাল। অন্যদিকে দুই নৌকা একসঙ্গে করে বেড় জাল দিয়ে পানি ছেঁকে তুলে আনা হচ্ছে ছোট-বড় সব মাছ।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, উপজেলার
হুলিয়ার, হিজলজানি, মাখরানবিল, দোলালিয়া, বালুধারা, বারুদবিল, সোনাই হাওর, বোয়ালিয়া বিল, মানধুরা বিল, ডালাচিনা বিল সহ বিভিন্ন ছোট-বড় হাওর-বিল, জলাশয় ও নদী নালার পানিতে পোনা মাছ নিধন করছে এক শ্রেণীর অসাধু মৎস্য আহরণকারীরা। নিধনকৃত পোনা মাছের মধ্যে রয়েছে টাকি, সোল, গজার। মশারীর জাল দিয়ে ঠেলা জালি বানিয়ে নিধন করছে টাকি, সোল ও গজারের পোনা। অপর দিকে ছাই দিয়ে, বাঁধ দিয়ে, কোনাজাল দিয়ে নিধন করছে টেংরা ও বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছের পোনা। প্রতিদিনই পোনামাছ নিধন করে দেধারছে বিক্রি করছে উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে। প্রতি কেজি টাকি কিংবা সোল মাছের পোনা বিক্রি হচ্ছে ৩শ' থেকে ৪শ' টাকা। আর প্রতি কেজি টেংরা কিংবা অন্যান্য মাছের পোনা বিক্রি হচ্ছে দু থেকে ৩শ' টাকা। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের ধারনা বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসে এ সমস্ত পোনা মাছ নিধন রোধ করা গেলে বর্ষাকালে হাওরে আর মাছের অভাব হত না। এইসব কারণে হাওরাঞ্চলে মাছের আকাল থাকে এতে হাওরের জীব বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।
মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০-এ বলা হয়েছে, নির্বিচারে পোনা মাছ ও প্রজননক্ষম মাছ নিধন মৎস্য সম্পদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। চাষের উদ্দেশ্য ব্যতীত কেউ প্রতিবছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর (আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি থেকে পৌষ মাসের মাঝামাঝি) পর্যন্ত ২৩ সেন্টিমিটারের (৯ ইঞ্চি) নিচে থাকা কাতলা, রুই, মৃগেল, কালবাউশ, ঘনিয়াসহ দেশি প্রজাতির মাছ নিধন করতে পারবে না। চাষের উদ্দেশ্যে মাছ ধরতেও জেলা মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। অন্যদিকে মাছ ধরার ক্ষেত্রে ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার বা তার চেয়ে কম ফাঁসবিশিষ্ট জাল ব্যবহার করা যাবে না। আইন অমান্য করলে ১ মাস হতে সর্বোচ্চ ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে।
ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের কিশোরগঞ্জ মনিটরিং এরিয়ার তাড়াইল সাংগঠনিক অফিসের অফিস ইনচার্জ সুলতান মুহাম্মাদ নাসির উদ্দিন বলেন, এখন হাওর অঞ্চলের বাজারগুলো বছরের বেশির ভাগ সময়ই থাকে পাঙ্গাস মাছের দখলে। তারপরও হাওরবাসী মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণে কতটা আন্তরিক? সবার চোখের সামনেই পোনা নিধন উৎসব চললেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অবিলম্বে হাওরে পোনা নিধন বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি দায়িত্ব রয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। তিনি আরো বলেন, অর্থনৈতিক মহামন্দা থেকে মুক্তির জন্য অর্থনীতিবিদরাই কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। তার পাশাপাশি একটু মনোযোগ দিলে হাওরে মাছের উৎপাদন একশো গুণ বাড়ানো সম্ভব। কথার কথা নয়, এটাই বাস্তবতা। যদি তিন মাস মাছ ধরা বন্ধ রেখে জেলেদের প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি কঠোর মনিটরিং করা হয় তাহলে হু হু করে মাছের ফলন বাড়বে। এতে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি হত। আমরা মন্দার প্রভাব থেকে বাঁচতে পারতাম। মাছ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারতাম। সেজন্য দরকার একটু বাড়তি মনোযোগ। দরকার সুষ্ঠু তদারকি ও একটি জুতসই পরিকল্পনা।
এ ব্যাপারে তাড়াইল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিত পন্ডিত বলেন, মৎস্য শিকারিদের দাবি যৌক্তিক। সব দিক বিবেচনা করেই মৎস্য সংরক্ষণ আইন করা হয়েছে। প্রচারপত্র বিলি ও শিকারিদের সঙ্গে বৈঠক করে পোনামাছ নিধন বন্ধের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা শুরু করেছি।